জাতীয়
‘তাদেরকে গুলি কর’: বিক্ষোভকারীদের গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা, আল-জাজিরার অনুসন্ধান
২৪ জুলাই, ২০২৫
4 মিনিট
আল জাজিরা।। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর তাঁর সরকারের নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের ‘ওপেন’ আদেশ দিয়েছিলেন।
আল জাজিরা।। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর তাঁর সরকারের নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের ‘ওপেন’ আদেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যেখানে তাঁদের পাবে, গুলি করবে। আল-জাজিরার হাতে আসা শেখ হাসিনার ফোনালাপের গোপন রেকর্ডে এমনটা উঠে এসেছে।
টানা প্রায় ১৫ বছর বাংলাদেশ শাসন করেছেন শেখ হাসিনা। কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভ এবং বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সরকারি বাহিনীগুলোর নৃশংস পদক্ষেপের পর গত ৫ আগস্ট তিনি পদত্যাগ করেন এবং ভারত পালিয়ে যান। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তথ্য অনুযায়ী, এই বিক্ষোভ ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ১ হাজার ৪০০ জনকে হত্যা এবং ২০ হাজারের বেশি মানুষকে আহত করেছে।
ফোনালাপ রেকর্ডিংগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে কোনো কারসাজি করা হয়েছে কি না, তা যাচাই করার জন্য অডিও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে বিশ্লেষণ করিয়েছে আল-জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট (আই-ইউনিট)। এ ছাড়া ভয়েস ম্যাচিংয়ের (কণ্ঠ মিলিয়ে দেখা) মাধ্যমে ফোনালাপকারীদেরও শনাক্ত করা হয়েছে।
ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) কর্তৃক গত বছর ১৮ জুলাই রেকর্ড করা একটি ফোনকলে শেখ হাসিনা তাঁর এক সহযোগীকে বলেন, তিনি তাঁর নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার নির্দেশনা দেওয়া আছে। ওপেন নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছি একদম। এখন লিথাল ওয়েপনস (প্রাণঘাতী অস্ত্র) ব্যবহার করবে। যেখানে পাবে, সোজা গুলি করবে। ওইটা বলা আছে। আমি এত দিন বাধা দিয়ে রাখছিলাম...ওই যে স্টুডেন্টরা ছিল, ওদের সেফটির (নিরাপত্তার) কথা চিন্তা করে।’
পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটির তৎকালীন মেয়র ও তাঁর আত্মীয় ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে এই ফোনালাপে বিক্ষোভ দমনে হেলিকপ্টার ব্যবহার নিয়ে কথা বলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। ফোন রেকর্ডে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘যেখানেই গ্যাদারিং (জমায়েত) দেখবে, সেখানে ওপর থেকে...এখন ওপর থেকে করা হচ্ছে, অলরেডি শুরু হয়ে গেছে কয়েকটা জায়গায়। কিছু (বিক্ষোভকারী) সরে গেছে।’
ওই সময় বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার বিষয়টি অস্বীকার করেছিল। তবে ঢাকার পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শাবির শরিফ আল-জাজিরার আই-ইউনিটকে বলেন, আমাদের হাসপাতালের সামনে হেলিকপ্টার থেকে টার্গেট করে গুলি ও টিয়ার শেল ফেলা হয়েছে।
চিকিৎসক শাবির শরিফ বলেন, চিকিৎসকেরা আহত বিক্ষোভকারীদের চিকিৎসা দেন, যাঁদের গুলির জখম ছিল অস্বাভাবিক। তিনি বলেন, এসব বুলেট হয় কাঁধ অথবা বুক দিয়ে ঢুকেছিল এবং সেগুলো শরীরের ভেতরে থেকে গিয়েছিল। আমরা ওই সময় এ ধরনের আরও রোগী পাচ্ছিলাম। এই চিকিৎসক বলেন, আমরা যখন এক্স-রেগুলো দেখছিলাম, তখন এত গুলি দেখে আমরা অবাক হয়েছিল। তবে কী ধরনের গুলি ব্যবহার করা হয়েছিল, তা যাচাই করে দেখতে পারেনি আল-জাজিরা।
এসব ফোনালাপ তথ্যপ্রমাণ আকারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করতে পারেন প্রসিকিউটররা। এই আদালত শেখ হাসিনা, তাঁর মন্ত্রীদের এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ গঠন করেছে। গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা ও অন্য দুজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। আগামি আগস্ট মাসে তাঁদের আনুষ্ঠানিক বিচার শুরুর কথা রয়েছে।
শেখ হাসিনার নজরদারির নেটওয়ার্ক এনটিএমসি এসব ফোনালাপ রেকর্ড করে। এনটিএমসির বিরুদ্ধে শুধু বিরোধী লোকজনের ওপরেই নয়, এমনকি হাসিনার রাজনৈতিক মিত্রদের ওপরও গোয়েন্দাগিরি করে বলে আগেই অভিযোগ ছিল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী জানতেন তাঁর ফোনালাপ রেকর্ড করা হচ্ছে। তাজুল ইসলাম বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হতো, ফোনে এ বিষয়ে আমাদের কথা বলা উচিত হবে না। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জবাব ছিল, হ্যাঁ, আমি জানি, জানি; আমি জানি এটা রেকর্ড করা হচ্ছে; সমস্যা নেই।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বলেন, তিনি (শেখ হাসিনা) অন্যের জন্য অনেক গভীর গর্ত খুঁড়েছিলেন। এখন তিনিই এই গর্তে পড়েছেন।
উত্তরাঞ্চলীয় শহর রংপুরে গত বছরের ১৬ জুলাই বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে নিহত হন শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তাঁর মৃত্যু ওই আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এতে সারা দেশে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং বিক্ষোভ তীব্র হয়।
গোপনে রেকর্ড হওয়া এক ফোনালাপে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগী এবং তাঁর বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার চেষ্টা করতে শোনা যায়। এই ফোনালাপে তিনি তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের কাছে জেরার সুরে জানতে চেয়েছিলেন, প্রতিবেদন কোন পর্যায়ে আছে ?
ফোনালাপে সালমান এফ রহমান বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেতে এত দেরি হচ্ছে কেন? কে লুকোচুরি খেলছে? রংপুর মেডিকেল ? তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কথা বলছিলেন। ওই হাসপাতালে আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত করা হচ্ছিল।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক রাজিবুল ইসলাম আল-জাজিরাকে বলেন, একাধিক গুলির জখমের বিষয়টি বাদ দিতে পুলিশ তাঁকে পাঁচবার আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছিল।
রাজিবুল হক বলেন, তারা (পুলিশ) এমন একটি প্রতিবেদন লেখাতে চেয়েছিল যে আবু সাঈদ ভাই ইটপাটকেলের আঘাতে আহত হয়ে মারা গেছেন...যদিও তিনি মারা গেছেন পুলিশের গুলিতে।
আল-জাজিরাকে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র দাবি করেছেন, শেখ হাসিনা কখনোই ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেননি এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগে সুনির্দিষ্ট অনুমোদন দেননি। ওই মুখপাত্র বলেন, এই (শেখ হাসিনার ফোনালাপ) রেকর্ডিং হয় আলাপের খন্ডাংশ বা বিকৃত করা হয়েছে অথবা দুটিই করা হয়েছে। আবু সাঈদের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে সরকারের ‘আন্তরিক’ প্রচেষ্টা ছিল বলেও লিখিত বক্তব্যে দাবি করা হয়।