মতামত
রামু থেকে গঙ্গাচড়া: অভিন্ন চিত্রনাট্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা
৩১ জুলাই, ২০২৫
6 মিনিট
লিখাঃ শাহেদ কায়েস তথ্যসূত্রঃ বিডিনিউজ২৪ ডট কম
ধর্ম অবমাননার অভিযোগে একের পর এক সংখ্যালঘু পাড়া পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। রামু থেকে গঙ্গাচড়া পর্যন্ত একই চিত্রনাট্যের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। নীরব সমাজের দায় কী বাড়ছে না?
আবারও গঙ্গাচড়া। এবার আক্রান্ত হয়েছে আলদাদপুর বালাপাড়া গ্রামের হিন্দুরা। এর আগে ২০১৭ নভেম্বরে রংপুর জেলার এই উপজেলাটিরই ঠাকুরপাড়া গ্রামে একই রকম একটি ঘটনায় সংখ্যালঘুরা সহিংসতার শিকার হয়েছিল। সেবার ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছিল জনৈক টিটু রায়ের নামে, যিনি চাকরিসূত্রে থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। এবার অভিযোগ তোলা হয়েছে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক এক কিশোরের নামে।
দুজনের বিরুদ্ধেই মহানবী হয়রত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগ আনা হয়েছে। ১৭ বছরের কিশোরটি একটি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র; তার বাবা এলাকার পল্লী চিকিৎসক। কিশোরটি এখন জেল হাজতে আছেন। যতদূর জেনেছি টিটু রায়ও আছেন জেলে।
কক্সবাজারের রামু থেকে সর্বশেষ গঙ্গাচড়ার বালাপাড়ায় হামলা পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার একটা নতুন প্যাটার্ন তৈরি হয়েছে। রামুর ঘটনায় যে উত্তমকুমার বড়ুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, পরে প্রমাণ হয়েছে, তিনি ধর্ম অবমাননার মতো কোনো ঘটনা ঘটাননি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের রসরাজ দাস তো মোবাইল ফোনের ব্যবহারই জানতেন না। তবু ধরে নিলাম, উত্তম, রসরাজ, টিটু রায় এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোরটি সত্যি ধর্ম অবমাননা করেছেন, কিন্তু ব্যক্তির অপরাধের দায় কেন একটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বহন করতে হবে–সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে যাদের সংখ্যা নিরন্তর কমেই চলেছে।
ধর্মীয় সহিংসতার আদিপাপ লুকিয়ে আছে ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগে। ভারত ভাগের অব্যবহিত আগে-পরে অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ছিল যেন এক ভয়াবহ অভিশাপ। পাঞ্জাবের দাঙ্গা ছিল ত্রিমুখী—হিন্দু, মুসলিম ও শিখদের মধ্যে হয়েছে ওখানকার দাঙ্গা। উপমহাদেশের ইতিহাসে তো বটেই, সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসেও এটি সবচেয়ে বড় ধর্মভিত্তিক বিভাজন। সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে লক্ষ-লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত এবং সহিংসতার শিকার হয়।
পরে হয়েছে—‘এখানে তুমি সংখ্যালঘু, ওখানে তুমি জমজমাট।’ কারণ ভারত ভাগের সঙ্গে ভাগ হয়েছে বাংলাও। বাংলার পশ্চিম অংশ ভারতের সঙ্গে থেকে যায় পশ্চিমবঙ্গ নাম নিয়ে, পূর্ব অংশ হয়ে যায় পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৬৪ সালে শ্রীনগরের হযরতবাল দরগার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানজুড়ে দাঙ্গা হয়েছিল। তবে পূর্ব পাকিস্তানে এর প্রভাব পড়ে তীব্রভাবে। পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেই সময় থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের নিপীড়নের ভূমি তৈরি হয়।
ভারত ভাগের কয়েক বছর পর ১৯৫১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুরা ছিল প্রায় ২২ শতাংশ। ১৯৬১ সালের আদমশুমারিতে এই হার কিছুটা কমে দাঁড়ায় প্রায় ১৮.৫ শতাংশে। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার পরপরই জনসংখ্যার হার আরও কমে আসে। ১৯৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আদমশুমারিতে দেখা যায় হিন্দুদের জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৩.৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে একটি নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছিল—মনে করা হয়েছিল, স্বাধীন দেশে যাবতীয় সাম্প্রদায়িক ভেদরেখা মুছে যাবে। কিন্তু বাস্তবে সেই স্বপ্ন কখনো পূর্ণ হয়নি। যুদ্ধ শেষে অনেক হিন্দু পরিবার ভারতের শরণার্থী শিবির থেকে ফিরে এসে তাদের ভিটেমাটি ফিরে পায়নি। এমন খবর পাওয়ার ফলে কেউ কেউ ভারত থেকে দেশে ফেরাটাকেই নিরাপদ মনে করতে পারেনি।
প্রকৃতপক্ষে ভারত ভাগের পর থেকে হিন্দুরা বাংলার এই অংশে—অর্থাৎ একাত্তরে যে অংশটি বাংলাদেশ নামে স্বাধীনতা লাভ করে—সেখানে কখনও খুব একটা ভালো অবস্থায় ছিল না। ১৯৭৪ থেকে ২০২২ পর্যন্ত জনজরিপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রায় ৭৫ লাখ হিন্দু হারিয়ে গেছে দেশ থেকে। ২০০১ সালের আদমশুমারিতে হিন্দুরা ছিল ৯.৬ শতাংশ। ২০১১ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৮.৫ শতাংশে। সর্বশেষ ২০২২ সালের আদমশুমারিতে হিন্দুদের হার ৭.৯৫ শতাংশে নেমে আসে। এর প্রায় এক দশক আগে ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পরও হিন্দুদের টার্গেট করে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল। নির্বাচনি জয়োৎসবের আড়ালে চলেছিল লুটপাট, দখল ও ধর্ষণের মতো নৃশংসতা।
দেশভাগের মূল দর্শনই ছিল ধর্মভিত্তিক জাতি নির্মাণ, যা কোনোভাবেই অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তৈরি করতে পারেনি। সেই ভাঙনের রক্তাক্ত ফলাফল আমরা পরবর্তীকালে দেখতে পেয়েছি এই ভূখণ্ডে—১৯৬৪, ১৯৭১, ২০০১, ২০১২, ২০১৬ থেকে বিভিন্ন সময়ে। ২০২৫ সালে গঙ্গাচড়া আরেকটি উদাহরণ হিসেবে যুক্ত হলো।
গত ২৬ জুলাই রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার আলদাদপুর বালাপাড়া গ্রামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুক পোস্টে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)–কে কটূক্তির ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা ছড়ায়, তা পরিণত হয় সহিংসতায়। সনাতন ধর্মাবলম্বী যে কিশোরটি ওই পোস্ট দিয়েছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে, তার বাড়িসহ আশপাশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৪টি বসতবাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। ঘটনার পর থেকেই এলাকায় বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ভীত ও উদ্বিগ্ন। অনেকে নিজেদের গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি ও ধান ভ্যানে করে সরিয়ে নিচ্ছেন নিরাপদ আশ্রয়ে।
নবী মুহাম্মদ (সা.)–কে নিয়ে ফেইসবুকে অবমাননাকর পোস্ট দেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, সেটির সত্যতা নিয়ে এখনও প্রশ্ন রয়ে গেছে। সেই কিশোর আদৌ ওই পোস্ট দিয়েছে কি না, তা এখনও অনিশ্চিত। অথচ নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার কিছু লোক মাইকিং করে এই অভিযোগ প্রচার করে এবং সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে তোলে বালাপাড়ায় হামলার জন্য। প্রশাসনিকভাবে আলদাদপুর বালাপাড়া রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার একটি গ্রাম হলেও ভৌগোলিকভাবে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের লাগোয়া। এই মাইকিংই ছিল উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছে যে কিশোরের বিরুদ্ধে, তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শুরু থেকেই। পুলিশ সাইবার সুরক্ষা আইনে মামলা করে অভিযুক্ত কিশোরকে আটক করেছে। এরপর তাকে আদালতের মাধ্যমে সম্মিলিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এরপরেও উত্তেজিত জনতা মিছিল নিয়ে এসে তাদের বাড়িঘরে হামলা করেছে, ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে।
এই সহিংসতার কেন্দ্রস্থল ছিল আলদাদপুর নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আলদাদপুর দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকা। বর্তমানে এই দুটি স্কুল কার্যত বন্ধ। বিদ্যালয় দুটির ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
বলা হলো, এক কিশোর ফেইসবুকে ইসলাম নিয়ে কটূক্তি করেছে। তদন্ত হয়নি, প্রমাণ মেলেনি, অথচ লাঠিসোটা নিয়ে একদল মানুষ হিন্দু পাড়ায় ঢুকে পড়ল। বলল, ‘ধর্ম অবমাননা হয়েছে।’ কিন্তু ধর্ম কি এতটা দুর্বল? আর যদি অবমাননাও হয়, বিচার কি আদালতের কাজ নয়? ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার নামে ঘর পুড়িয়ে দিলে, গরু নিয়ে গেলে, নারীর গলার সোনার চেইন ছিঁড়ে নিলে, সেটা কি পুণ্য হয়? আমরা বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখি—একটা পোস্ট, একটা গুজব, একটা নাম। তারপর একের পর এক গ্রাম, বাড়ি, মন্দির, বিহার ভেঙে পড়ে। আর আমরা, যারা নিজেদের মানুষ বলে পরিচয় দিই, আমরা কেবল চুপ করে থাকি। যেমন চুপ ছিলাম রামুতে, যেমন চুপ ছিলাম নাসিরনগরে, তেমন এবারও চুপ করে দেখছি গঙ্গাচড়ার সাম্প্রদায়িক সহিংসতা।
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলার রামুতে বৌদ্ধদের ওপর পরিচালিত ভয়াবহ হামলা ছিল এ ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রথম দিককার বড় উদাহরণ। উত্তম কুমার বড়ুয়া নামে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এক তরুণের ফেইসবুকে কুরআন অবমাননাকর ছবি ট্যাগ করা হয়েছিল, যা আসলে উত্তমের পোস্ট ছিল না। অথচ সেই গুজবকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধদের শত বছরের পুরনো মন্দিরগুলো এক রাতে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা তখন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ, তদন্ত ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল, বিচারের কোনো আলামত দেখা যায়নি।
২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত উত্তম আত্মগোপনে থাকলেও পরিবার ও পরিচিতদের সঙ্গে অজ্ঞাত স্থান থেকে যোগাযোগ করতেন বলে জানা যায়। তবে এখন আর তার কোনো খবর নেই। নাসিরনগরের রসরাজ দাস জামিনে থাকলেও মামলার ঘানি টানা থেকে নিষ্কৃতি মেলেনি তার। রসরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল এই বলে যে তিনি কাবাশরিফের ছবির ওপর এক হিন্দু দেবতার ছবি ফটোশপ করে ফেইসবুকে পোস্ট করেছিলেন। পরে জানা গেল, ফটোশপ করা তো দূরের কথা, তিনি ভালো করে মোবাইল ব্যবহার করতেও জানেন না।
রামুর পর নাসিরনগর, রংপুরের পীরগঞ্জ, ভোলার বোরহানুদ্দীন, সুনামগঞ্জের দিরাই-শাল্লা এবং সর্বশেষ দ্বিতীয়বারের মতো রংপুরের গঙ্গাচড়ার ঘটনা আমাদের সামনে একই ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। একের পর এক ফেইসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার এই পদ্ধতিটি যেন এখন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার একটি নতুন কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি আর কোনো দ্বিপক্ষীয় সংঘাত নয়, বরং একতরফা হামলা—সংখ্যালঘুদের ওপর সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত নিপীড়ন। রামুর ঘটনা থেকে আমরা একটা প্যাটার্নই লক্ষ্য করছি, সেটা হলো গুজব, উগ্রতা, সংগঠিত হামলা, ভাঙচুর-লুটপাট-ধর্ষণ, এরপর রাষ্ট্রের বিচারহীনতা। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুককে ব্যবহার করা হয়েছে। যেন একটাই চিত্রনাট্য, শুধু স্থান আর শিকার বদলায়।
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, এই হামলার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ সংখ্যাগরিষ্ঠের নীরবতায় বৃদ্ধি পায়। যারা প্রকাশ্যে হামলায় অংশ নেয় না, তারাও নীরব দর্শক হয়ে থাকে। এই নীরবতা আসলে সহাবস্থানহীনতার বার্তা দেয়, যা সংখ্যালঘুদের, সে হোক ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘু, তাদের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। একইসঙ্গে এটি স্মরণ করিয়ে দেয়, সংখ্যাগরিষ্ঠের নীরবতা আসলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের বড় প্রতিবন্ধক।