সাংগঠনিক খবর
বৈষম্য দূরীকরণে চলমান সংস্কার কার্যক্রমে সংখ্যালঘুদের আলোচনার বাইরে রাখায় ঐক্য পরিষদের গভীর ক্ষোভ প্রকাশ
৯ জুলাই, ২০২৫
5 মিনিট
সংবাদ বিজ্ঞপ্তি।। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বাইরে রেখে সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণে সংবিধানসহ সংস্কার কার্যক্রম চলমান থাকায় গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ
সংবাদ বিজ্ঞপ্তি।। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বাইরে রেখে সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণে সংবিধানসহ সংস্কার কার্যক্রম চলমান থাকায় গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও এর নেতৃত্বাধীন সংখ্যালঘু ঐক্যমোর্চা।
ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে আব্দুস সালাম হলে আজ বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) সকালে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের অন্যতম সভাপতি নির্মল রোজারিও। উপস্থিত ছিলেন অন্যতম সভাপতি অধ্যাপক ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক, সভাপতিম-লীর সদস্য কাজল দেবনাথ, জে এল ভৌমিক, সভাপতিম-লীর সদস্য রঞ্জন কর্মকার, সংখ্যালঘু ঐক্যমোর্চাভুক্ত বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের নির্বাহী মহাসচিব পলাশ কান্তি দে, ঋষি পঞ্চায়েত ফোরামের সভাপতি রামানন্দ দাস। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাড. দিপংকর ঘোষ।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী আশা করেছিল যে, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান বৈষম্য ও নিপীড়নসমূহ চিহ্নিত করে তা অবসানের লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপের সুপারিশ করার জন্য আলাদাভাবে একটি সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হবে। কিন্তু আমরা প্রথমেই লক্ষ্য করলাম, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য কোন আলাদা কমিশন গঠন করা হয়নি। পরবর্তীতে যে সকল কমিশনসমূহ গঠন করা হয়েছে সেখানেও ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্য থেকে কোন প্রতিনিধি রাখা হয়নি। এমনকি সংবিধান সংস্কার কমিশনেও কোন সংখ্যালঘু প্রতিনিধি নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান বৈষম্যসমূহ নিয়ে আলোচনার জন্যে কমিশনগুলো কোন সংখ্যালঘু প্রতিনিধিদলের সাথে আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেনি। উল্লেখ থাকে যে, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে কমিশনে বেশ কিছু লিখিত প্রস্তাবনা পাঠানোর পরও এ বিষয়সমূহ নিয়ে তাদের সাথে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা মনে করেননি। এ কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমান বাংলাদেশের ১০%-র অধিক ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব ও অংশীদারিত্বের বিষয়টিকে কোনরূপ বিবেচনায় না নিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে। রাজনৈতিক দলগুলোও ইতোমধ্যে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন যা চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আমরা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে এ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছি ও প্রতিবাদ জানাই এবং একই সাথে আমরা বলতে চাই, এর মধ্য দিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান বৈষম্য ও নিপীড়নকে চ্যালেঞ্জ না করে তা টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে, যা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, বৈষম্যহীন ও মানবিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে কখনোই আমরা আশা করিনি। আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা আজ ঐক্যবদ্ধ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে, অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এবং অস্তিত্ব রক্ষায়।
চলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সারা দেশব্যাপী ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সহিংসতা চালানো হয়েছে যা আজও অব্যাহত রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে গত ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গত ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট, ২০২৪ পর্যন্ত সারা দেশব্যাপী সংঘটিত ২০১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার চালচিত্রসম্বলিত আংশিক তালিকা এবং একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছিল আপনাদের সহযোগিতার মাধ্যমে দেশবাসী, রাজনৈতিক দলসমূহ ও নাগরিক নেতৃবৃন্দ এবং সরকারের সহৃদয় অবগতির জন্যে। উক্ত সংবাদ সম্মেলনে অনতিবিলম্বে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধ, এর সাথে জড়িত দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় এনে গ্রেফতার এবং বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন, আহতদের সুচিকিৎসার পদক্ষেপ গ্রহণের জোর দাবি জানানো হয়।
লিখিত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আমরা দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, সরকারের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সম্পর্কিত ঘটনাবলীকে কোনপ্রকার গুরুত্ব না দিয়ে ঐক্য পরিষদের উত্থাপিত রিপোর্ট মিথ্যা, অতিরঞ্জিত ও বানোয়াট বলে অস্বীকার করার কৌশল নেয়া হয়। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমের ঐকান্তিক সহায়তায় দেশী-বিদেশী গণমাধ্যম উক্ত রিপোর্টে উল্লেখিত সহিংসতার ঘটনার উপর বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করায় তা দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংস্থা, পার্লামেন্ট ও সরকার এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাবলীকে বিভিন্নভাবে তুলে ধরার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪ তারিখে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বীকার করেন যে, বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এবং তা বন্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ইতোমধ্যে ৮৮টি মামলায় ৭০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
আরও বলা হয়, আমরা বারবার বলে এসেছি চলমান সহিংসতাকে যে যেভাবেই ব্যাখ্যা করুক না কেন ঐক্য পরিষদ মনে করে, গত ৪ আগস্ট থেকে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নিশানা করে তাদের বাড়িঘর, উপাসনালয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত সকল হামলা, ভাংচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণ, হত্যা ও জোরপূর্বক নিরব চাঁদাবাজিসহ যাবতীয় অপরাধের শিকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এ ধরণের সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনা শুধু ফৌজদারী অপরাধই নয়, এটি মানবতার বিরুদ্ধেও অপরাধ এবং তা এখনও চলমান। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে দোষীদের সনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে এসে যথাযথ বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার উদ্যোগ একেবারেই লক্ষণীয় নয়। এই পরিস্থিতি একদিকে সন্ত্রাসীদের এ ধরনের ঘৃণ্য কাজ করতে উৎসাহিত করছে অপরদিকে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের মানবাধিকার পাওয়া এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত এ সময়কালের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার চালচিত্র তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এ সময়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২৭টি, নারী নির্যাতন/ধর্ষণ/গণধর্ষণ ২০টি, উপাসনালয়ে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ ৫৯টি, কথিত ধর্মঅবমাননার অভিযোগে গ্রেফতার ও নির্যাতন ২১টি, বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ ৮৭, জোরপূর্বক বাড়িঘর, জমি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল ১২টি, শারীরিক নির্যাতন ও জোরপূর্বক পদত্যাগ ৪টি, আদিবাসীদের ওপর হামলা, নির্যাতন ১২টি, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে বাধা, অপহরণ ও বিবিধ ১৬টি অর্থাৎ মোট সহিংসতার ঘটনা ২৫৮টি। এটি সামগ্রিক সহিংসতার একটি আংশিক চিত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বেশ কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিহাটি গ্রামে ২০টি সংখ্যালঘু পরিবারের সর্বস্ব লুটপাটের পর বাড়িঘর ভষ্মিভূত করে দেয়া, কুমিল্লার মুরাদনগরে সংখ্যালঘু মহিলাকে ধর্ষণ করে তার ভিডিও চিত্র সামাজিক মাধ্যমে ছেড়ে দেয়া, ঢাকার খিলক্ষেতে বিনা নোটিশে সরকারি বুলডোজার দিয়ে বিভিন্ন দেবদেবীর প্রতিমাসহ মন্দির গুড়িয়ে দেয়া, লালমনিরহাটে সেলুন ব্যবসায়ী পরেশ চন্দ্র শীল ও তার ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র শীলকে কথিত ধর্মঅবমাননার মিথ্যা অভিযোগ এনে গণপিটুনি ও পুলিশের নিকট সোপর্দ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক ড. কুশল বরণ চক্রবর্তীকে উপচার্য কার্যালয়ে উপাচার্যসহ অন্যান্য শিক্ষকদের সম্মুখে মব সৃষ্টির মাধ্যমে হেনস্থা করে পদোন্নতি রুখে দেয়া, সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মচারীর জামিন বাতিল করে কথিত মামলায় পুনরায় তাকে কারাগারে প্রেরণ যা চলমান সাম্প্রদায়িকতার জ্বলন্ত উদাহরণ।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যানের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্র নাথ বসু, সাংগঠনিক সম্পাদক পদ্মাবতী দেবী, ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক প্রাণতোষ আচার্য শিবু, যুব ঐক্য পরিষদের সভাপতি শিমুল সাহা, সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের উপদেষ্টা মিঠুন ভট্টাচার্য শুভ, ছাত্র ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সজীব সরকার ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দিপংকর চন্দ্র শীল প্রমুখ।