জাতীয়
কাকুতি-মিনতি করেও মবের হিংস্রতা থেকে বাঁচতে পারেননি রূপলাল ও প্রদীপ দাস
১১ আগস্ট, ২০২৫
3 মিনিট
রংপুরের তারাগঞ্জে রূপলাল রবিদাস ও প্রদীপ দাস নামে দুই ব্যক্তিকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
একদল লোকের মবের শিকার হয়ে প্রাণ হারান রূপলাল রবিদাস ও তার ভাগনি জামাই প্রদীপ দাস। ভুক্তভোগীদের কাকুতি-মিনতিতে মন গলেনি হিংস্র মবের। লোমহষর্ক এই ঘটনার পর পুরো এলাকা শোকে স্তব্ধ। ক্ষোভ আর প্রতিক্রিয়ায় উত্তাল হয়ে উঠেছে বেলতলী এলাকা। মহাসড়কে লাশ রেখে করা হয়েছে বিক্ষোভ।
রোববার ( ১০ আগস্ট) সন্ধ্যায় রংপুরের তারাগঞ্জের রংপুর-দিনাজপুরের মহাসড়কের বেলতলী এলাকায় ওই বিক্ষোভ করা হয়। এতে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। একই দিন-দুপুরে থানায় হত্যা মামলা করেন রূপলালের স্ত্রী মালতী রানি দাস । এর আগে, শনিবার রাতে তারাগঞ্জ বুড়ির বটতলা এলাকায় মারধরের শিকার হন রূপলাল ও প্রদীপ। এতে ঘটনাস্থলে রূপলালের মৃত্যু হয়। তিনি তারাগঞ্জ বাজারে জুতা সেলাইয়ের কাজ করতেন।
অন্যদিকে, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় রোববার ভোরে মারা যান প্রদীপ দাস। ৪০ বছরের রূপলাল তারাগঞ্জ ও ৩৮ বছর বয়সী প্রদীপ মিঠাপুকুরের বাসিন্দা।
রোববার সন্ধ্যায় রূপলালের লাশ বাড়িতে পৌঁছানোর পর ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা লাশ রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কে রেখে বিক্ষোভ শুরু করেন।
স্থানীয় কয়েকজন জানান, রূপলাল বারবার বাঁচার অনুরোধ করেছিলেন; কিন্তু কারও মন গলেনি। তাদের নির্মমভাবে পেটানো হয়। বাঁচার জন্য অনেক আকুতি করেছিলেন তারা। কেউ শোনেনি। এই ঘটনার বিচার চান স্থানীয়রা।
পরবর্তীতে রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভের স্থানে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। এতে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। ওই সময় বিক্ষোভকারী ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন। তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অভিযুক্তদের চিহ্নিত না করলে বৃহত্তর আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হয়।
শনিবার (৯ আগস্ট) রাত সাড়ে ৮টার দিকে রূপলাল তার ভাগনি জামাই প্রদীপকে সঙ্গে নিয়ে মিঠাপুকুর থেকে ভ্যানে করে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে বুড়িরহাট বটতলা মোড়ে তাদের পথরোধ করেন স্থানীয় কিছু লোক। তাদের সন্দেহ হয়, প্রদীপের সঙ্গে থাকা ব্যাগে ‘অস্বাভাবিক’ কিছু রয়েছে।
তাদের ব্যাগ তল্লাশি করে প্লাস্টিক বোতলে দুর্গন্ধযুক্ত পানীয় ও কিছু ওষুধ পাওয়া যায়। এমন দাবির পর মুহূর্তেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পরে তাদের ভ্যানচোর সন্দেহে স্থানীয় বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে নিয়ে পেটানো হয়।
একপর্যায়ে তারা অচেতন হন। সেখানেই তাদেরকে ফেলে রাখা হয়। পরবর্তীতে রাত ১১টার দিকে তাদের উদ্ধার করে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয় পুলিশ। সেখানে রূপলাল দাসকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। ওই সময় প্রদীপ দাসকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার মৃত্যু হয়। স্থানীয়রা বলছেন, রূপলাল ও প্রদীপের কাছে চোলাই মদ ছিল। এ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
নিহতদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, রুপলালের তার মেয়ের বিয়ে সংক্রান্ত আলোচনার জন্য প্রদীপকে আসতে বলেন। প্রদীপ রংপুরের মিঠাপুকুর থেকে নিজের অটোরিকশার চালিয়ে রূপলালের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন। তবে প্রদীপ পথ ভুল করে বটতলা নামক স্থানে পৌঁছে রূপলালকে ফোন করে বিষয়টি জানান। রূপলাল তাকে এগিয়ে আনতে বটতলা যান। পরে তারা একই অটোরিকশা করে রূপলালের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হন। পথে মারধরের শিকার হন দুজন।
জানতে চাইলে ১০ আগস্ট রাত পৌনে ১২ টার দিকে তারাগঞ্জ থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) এম এ ফারুক ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, এখন পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে আমাদের অভিযান চলছে। আশা করছি, শিগগির অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা যাবে। তিনি আরও বলেন, রূপলালের স্ত্রী বাদী হয়ে থানায় হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় ৫০০ থেকে ৭০০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
এদিকে লাশ নিয়ে বিক্ষোভের সময় স্থানীয়রা জানান, মবের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। মিথ্যা, গুজব, সন্দেহে মবের শিকার হয়ে মানুষের জীবন চলে যাচ্ছে। রূপলাল ও প্রদীপের মৃত্যুর পর একই প্রশ্ন থেকে যায়- এভাবে আর কত প্রাণ যাবে?