Thin-Left
Thin-Right

Advertisement

Top Advertisement
‘জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা’ ও বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়
প্রবন্ধ

‘জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা’ ও বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়

১২ আগস্ট, ২০২৫
5 মিনিট

লিখাঃ এম. টি. ইসলাম তথ্যসূত্রঃ বিডিনিউজ২৪ ডট কম

শারীরিক আক্রমণ চোখে দেখা যায়, কিন্তু এমন এক সহিংসতা আছে যা দৃশ্যমান নয়—তবুও তার ক্ষত আরও গভীর। এটাই জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা। বাংলাদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা দীর্ঘদিন ধরেই এই অদৃশ্য সহিংসতার শিকার। সরল ভাষায়, ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা’ (এপিস্টোমোলোজিক্যাল ভায়োলেন্স) হলো জ্ঞানতত্ত্ব নির্মাণ ও চর্চার মাধ্যমে অন্য দল বা গোষ্ঠীকে ভুলভাবে উপস্থাপন, হেয় করা বা ক্ষতির মুখে ঠেলে দেওয়ার অভিপ্রায়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জ্ঞানতাত্ত্বিক কার্যক্রম। কানাডার ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত অধ্যাপক থমাস লিও মনোবিজ্ঞান গবেষণায় প্রথম এই পরিভাষা ব্যবহার করেন। পরে সমালোচনা তত্ত্ব (ক্রিটিক্যাল থিওরি) ও উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বের (পোস্টকলোনিয়্যাল থিওরি) গবেষকেরা এই পরিভাষা ব্যবহার করে এটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। মিশেল ফুকো, এডওয়ার্ড সাঈদ এবং গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক তাদের মধ্যে অন্যতম। মিশেল ফুকো জ্ঞানকে ক্ষমতার একটি উৎস হিসেবে দেখতেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে জ্ঞানতাত্ত্বিকতা ব্যবহার করে সমাজে একদল অন্য দল বা গোষ্ঠীকে শোষণ করে। অন্যদিকে, ‘ওরিয়েন্টালিজম’ ধারণার প্রবক্তা এডওয়ার্ড সাঈদ দেখিয়েছেন, কীভাবে ঔপনিবেশিক শক্তি জ্ঞান সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা চালিয়ে থাকে। প্রায় কাছাকাছি দৃষ্টিকোণ থেকে গায়ত্রী স্পিভাকও জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা ব্যাখ্যা করেছেন। তার বহুল আলোচিত প্রবন্ধ ‘ক্যান দ্য সাব-অলটার্ন স্পিক?’-এ তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে ঔপনিবেশিক জ্ঞানব্যবস্থা সাব-অলটার্নদের মতামতকে দমিয়ে রাখে। এই তাত্ত্বিকদের আলোচনা থেকে দেখা যায়, জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতার প্রক্রিয়ায় দুটি স্পষ্ট পক্ষ বিদ্যমান—‘উর্ধ্বতন’ ও ‘অধস্তন’। এক পক্ষ প্রচলিত জ্ঞানতত্ত্বকে ব্যবহার করে অন্য পক্ষ সম্পর্কে সমাজের ধারণা নিয়ন্ত্রণ করে। ‘সহিংসতা’ শব্দটির মধ্যে শারীরিক আক্রমণের ধারণা থাকলেও, জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা সবসময় শারীরিক নয়; বরং অনেক ক্ষেত্রে তার চেয়েও ভয়ঙ্কর। এ ধরনের সহিংসতায় মূলত সমাজের শিক্ষিত, অভিজাত ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী যুক্ত থাকে। অর্থাৎ, সমাজে যাদের প্রভাব আছে তারাই সাধারণত এই ধরনের সহিংসতায় অংশ নেয়। তারা নতুন নতুন বয়ানের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী সম্পর্কে বিদ্বেষপূর্ণ ও হেয়মূলক জ্ঞান তৈরি করে। যার ফলে সমাজে বৈষম্যমূলক বাইনারি বিভাজন সৃষ্টি হয়। যেমন, ‘গ্রামের মানুষ মানেই খ্যাত’, ‘হিন্দু মানেই ভারতপন্থী’, ‘হিন্দু মানেই নৌকায় ভোট দেয়’, ‘হিন্দু মানেই আওয়ামী লীগপন্থী’, ‘পাহাড়ি মানেই বিদ্রোহী’, ‘পাহাড়ি মানেই বাংলাদেশবিরোধী’। সমাজে প্রতিষ্ঠিত এমন অনেক বয়ান বিরাজমান, যা স্পষ্ট জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতার উদাহরণ। এই আলোচনার উদ্দেশ্য যেহেতু সংখ্যালঘুদের ওপর সংগঠিত জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা বিশ্লেষণ করা, তাই এখানে কেবল সংখ্যালঘুদের ঘিরে যে সহিংসতা, সেটিই উল্লেখ করা হয়েছে। সমাজের ক্ষমতাসীনরা নিজেদের সুবিধার্থে এ ধরনের জ্ঞান তৈরি করে। যুগের পর যুগ সমাজের প্রভাবশালীরা এই জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি নির্মাণ করেছে, যার মাধ্যমে তারা অধস্তনদের দমিয়ে রেখেছে এবং তাদের ওপর সামাজিক নিপীড়ন চাপিয়ে দিয়েছে। যেমন, স্পিভাক দেখিয়েছেন কীভাবে ঔপনিবেশিকদের তৈরি জ্ঞানচর্চার পদ্ধতি উপনিবেশগুলোতে সেখানকার জনগোষ্ঠীর মতামত দমিয়ে রেখেছে এবং কীভাবে ওই জ্ঞানতাত্ত্বিকতার ভিত্তিতে তারা তাদের ঔপনিবেশিকতাকে ন্যায্যতা প্রদান করেছে, অন্যায্যতাকেও ন্যায্য বলে প্রতিষ্ঠা করেছে। ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা’ নিয়ে বোঝার সুবিধার্থে শুধু নামের কারণে কাউকে ভারতপন্থী হতে হয় কিনা তেমন একটি বিতর্কের উল্লেখ করা যায়। যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আলোচনা ওই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আপাতদৃষ্টিতে শারীরিক ক্ষতি করেনি, তবুও সমাজে এই সম্প্রদায় সম্পর্কে একটি নতুন নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে, বা পূর্বে বিদ্যমান ধারণাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে। এই মন্তব্য সমাজে একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করেছে, যা সামাজিক সম্প্রীতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ ধরনের তাত্ত্বিক চিন্তার উৎপত্তি প্রথমে আপাত নিরীহ মনে হলেও, দীর্ঘমেয়াদে এটি নানা ধরনের বড় বিপর্যয় ডেকে আনে। যাদের বিরুদ্ধে এই বয়ান তৈরি হয়, তাদেরকে সমাজে এক ধরনের স্থায়ী হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়। এটি অনেক সময় শারীরিক আক্রমণের চেয়েও ভয়াবহ ও গভীর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতার ইতিহাস বেশ দীর্ঘ ও গভীর। ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, এখানে সবচেয়ে বড় জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে হিন্দু সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর এই জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতার মাত্রা বাড়তে থাকে। এর অন্যতম উদাহরণ হলো, ১৯৭১ সালের আগে থেকেই এই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ধারাবাহিকভাবে ‘ভারতপন্থী’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়ে আসছে। ১৯৭১ সালে জীবন দিয়ে যারা মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রেখেছে, ওই জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতার পরও নিজ দেশ বিদ্বেষী বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিসহ দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে সবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অবদান রাখলেও, এই নেতিবাচক বয়ানের কারণে তারা সমান সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিবেশ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। একই ঘটনা দেখা যায় পাহাড়ে বসবাসকারীদের ক্ষেত্রেও। দেশের স্বাধীনতা, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিসহ নানান ক্ষেত্রে এই আদিবাসীদের অনন্য অবদান থাকলেও, তাদেরকে আজও সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এটি নিঃসন্দেহে জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতার প্রত্যক্ষ প্রভাব। এমনকি আমরা যদি স্বাধীনতার যুদ্ধের ইতিহাসের বয়ান দেখি, সেখানেও শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষে বয়ান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নানান ক্ষেত্রে অবদান ও তাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের উল্লেখযোগ্য কোনো আলোচনা নেই; সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের বয়ানে ভরপুর। এই জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতায় কয়েকটি পক্ষ জড়িত। দেশের অভিজাত সম্প্রদায় থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যম—সবাই মিলে এই সহিংসতার ভিত্তি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আমরা যদি কোনো সংবাদমাধ্যমের সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবেদন দেখি, তাহলে দেখা যায়, এই ধরনের সহিংসতাকে প্রায়ই ‘জাতিগত সহিংসতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই ধরনের বয়ান সরাসরি জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতার অংশ হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১২ সালের রামুর সহিংসতা কিংবা ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর সংঘটিত হামলাকে উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০১২ সালের রামুর ঘটনায় সংবাদমাধ্যম একে ‘জাতিগত সহিংসতা’ বলে আখ্যা দেয়। জাতিগত সহিংসতার সরল অর্থ হলো, দুই পক্ষের সমানে সমান দ্বন্দ্ব—যেখানে দুপক্ষই আক্রমণকারী এবং একইসঙ্গে আক্রমণের শিকার। কিন্তু বাস্তবে ঘটনাটি ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। সেখানে একপক্ষ ছিল হামলাকারী আর অপরপক্ষ কেবল হামলার শিকার। ঠিক একই ধরনের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় ২০২৪ সালের ৫ অগাস্টের পর সংঘটিত ধারাবাহিক হামলার ক্ষেত্রেও। এই হামলাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ক্ষমতাসীনরা দেশে-বিদেশে এটিকে ‘বিগত ক্ষমতাসীনদের দোসরদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া’ বলে আখ্যা দেন। এর মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের ওপর সংঘটিত সহিংসতাকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়। এটিও সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতার অন্যতম স্পষ্ট উদাহরণ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, এই ধরনের জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা যেহেতু দেশের বিচার ব্যবস্থার ধরাছোঁয়ার বাইরে, তাই এই প্রক্রিয়ায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা অত্যন্ত কঠিন। ধর্ম বা ইতিহাস বিকৃতির ক্ষেত্রে কিছু আইনি সুরক্ষা থাকলেও, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতার কোনো নির্দিষ্ট আইনি সুরক্ষা এখনো নেই। তাই এখন সময় এসেছে জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা নিয়েও বিস্তৃতভাবে ভাবার এবং এ বিষয়ে কার্যকর আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থা গড়ে তোলার। এমন উদ্যোগ নেওয়া গেলে ভবিষ্যতে সমাজ ও সমাজের মানুষকে এই হীন ও পরোক্ষ সহিংসতার বিরুদ্ধে আরও কার্যকরভাবে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে।

Share this article

প্রবন্ধ

প্রবন্ধ বিভাগের সর্বশেষ খবর এবং আপডেট পেতে এই বিভাগে নিয়মিত ভিজিট করুন।

Advertisement

Sidebar Advertisement