ব্রেকিং নিউজ
ভারত-পাকিস্তানকে ‘ধৈর্য’ ধরতে বললেন জাতিসংঘ মহাসচিব
Thin-Left
Thin-Right

Advertisement

Top Advertisement
সংখ্যালঘু নির্যাতন ও মার্কিন গোয়েন্দা প্রধানের সতর্কবার্তা
প্রবন্ধ

সংখ্যালঘু নির্যাতন ও মার্কিন গোয়েন্দা প্রধানের সতর্কবার্তা

২৪ মার্চ, ২০২৫
6 মিনিট

তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্যে বাংলাদেশে ইসলামি চরমপন্থার উত্থান, সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং সন্ত্রাসবাদের হুমকিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ কি আসলেই বিপদে পড়তে যাচ্ছে?

চিররঞ্জন সরকার বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন, হিংসা-হানাহানি এবং ধর্মভিত্তিক চরমপন্থার উত্থান নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ডের সতর্কবার্তা নতুন করে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। গ্যাবার্ডের বক্তব্যে বাংলাদেশে ইসলামি চরমপন্থার উত্থান, সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং সন্ত্রাসবাদের হুমকিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ কি আসলেই বিপদে পড়তে যাচ্ছে? নাকি এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি অংশ? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক প্রভাবকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের ঘটনা কেবল সামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্বেগের কারণ নয়, বরং দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্যও হুমকিস্বরূপ। গত কয়েক মাসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, ধর্মীয় উপাসনালয় ভাঙচুর, জমি দখল ও শারীরিক নির্যাতনের বহু ঘটনা সামনে এনেছে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্ল্যাটফর্মগুলো এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সদস্যরা প্রায়শই উগ্রপন্থী গোষ্ঠী বা দুষ্কৃতীদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে কিংবা ধর্ম অবমাননার অজুহাতে হামলা চালানো হচ্ছে, যা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রেরই অংশ বলে মনে করা হচ্ছে। এই ঘটনাগুলো শুধু স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই, বরং আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। যদিও সরকারিভাবে হামলার ঘটনাগুলোকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অস্বীকার করা হচ্ছে। সংখ্যালঘু নির্যাতনের খবরগুলোকে স্রেফ মনগড়া কিংবা ভারতীয় মিডিয়ার ‘বাড়াবাড়ি’ বলে প্রচার করা হয়েছে। মুখে যত কথাই বলা হোক, আসলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আদর্শ দেশ হতে পারেনি। রামু থেকে নাসিরনগর– ধর্মীয় বিষয় নিয়ে ফেইসবুকে কখনও বানানো, কখনও আবার কল্পিত পোস্টের কারণ দেখিয়ে সহিংসতার ঘটনা ঘটানো হয়। সর্বশেষ গেল ৩ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারের মংলারগাঁওয়ে ঘটেছে তাণ্ডব। কিছু ধর্মবাদী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী প্রায়শই সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ায়। ফলে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও এই বিদ্বেষের কারণে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও এই জনগোষ্ঠীর বাড়িঘরে হামলা একটি নিয়মতি ঘটনায় পরিণত হয়েছে। তুলসী গ্যাবার্ড তার সাক্ষাৎকারে এই বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, “হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর দীর্ঘদিনের দুর্ভাগ্যজনক নির্যাতন, হত্যা ও নিপীড়নের ঘটনা মার্কিন সরকার এবং ডনাল্ড ট্রাম্প ও তার প্রশাসনের একটা বড় উদ্বেগের জায়গা।” এই বক্তব্য বাংলাদেশের সরকার ও প্রশাসনের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। সংখ্যালঘু নির্যাতন শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনই নয়, এটি দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক ইমেজের জন্য হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কথোপকথনের সময় ‘ইসলামি খেলাফত’ ও ইসলামি চরমপন্থার উত্থান প্রসঙ্গে তুলসী গ্যাবার্ড বলেন, “চরম ইসলামপন্থিদের হুমকি ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বৈশ্বিক যে প্রচেষ্টা, তাদের সবার শিকড় একই আদর্শ ও উদ্দেশ্যে মিশেছে। তাদের সে উদ্দেশ্য হল ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা।” বাংলাদেশে ইসলামি চরমপন্থার উত্থানের পেছনে নানা কারণ কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, শিক্ষার অভাব এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা। কিছু সংগঠন, বিশেষ করে চরমপন্থি গোষ্ঠী, এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে তাদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসলামি চরমপন্থার নামে হামলা, বোমা হামলা এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ঘটনা ঘটেছে, যা দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি তৈরি করেছে। তুলসী গ্যাবার্ডের সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ স্পষ্ট হয়েছে। তিনি এমনটিই বলেছেন যে, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে এবং ইসলামি সন্ত্রাসবাদকে পরাজিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে এই বক্তব্যকে শুধু মানবাধিকার ও নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যাবে না। এর পেছনে আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দক্ষিণ এশিয়া একটি কৌশলগত অঞ্চল। চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে ইসলামি চরমপন্থার উত্থান এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের কৌশলগত স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। গ্যাবার্ডের বক্তব্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত রয়েছে, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং আন্তর্জাতিক শক্তির ভূমিকা নিয়ে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। বিশেষ করে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের প্রতি মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো আস্থা হারাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। বাইডেন প্রশাসনের আশীর্বাদপুষ্ট অনেক ব্যক্তি এবং সংস্থা এখন প্রতিকূল অবস্থায় পড়তে পারে, বিশেষ করে যখন রিপাবলিকানরা পরবর্তী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্য এটিই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি পশ্চিমা মিডিয়ায় আরও বেশি আলোচিত হতে পারে এবং এটি রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসতে পারে। ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচন এবং ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে রিপাবলিকানরা ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সংক্রান্ত নীতির ব্যর্থতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। ইউএসএইড-এর মাধ্যমে বাংলাদেশে আসা তহবিল নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের অতীত সমালোচনাগুলোও নতুন করে সামনে আসতে পারে, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আরও চাপ তৈরি করবে। তবে বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক রাজনীতির চেয়ে আরও জটিল। এখানকার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কেবল ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর হাতে সীমাবদ্ধ নয়। রাস্তায় গণআন্দোলনের বাস্তবতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার গতিপথ এককভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। সম্প্রতি সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে সচেতনতা বাড়ছে, তা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। সময়ই বলে দেবে, এই পরিবর্তন কতটা গভীর এবং কার জন্য কতটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক হবে। বাংলাদেশের জন্য বর্তমান পরিস্থিতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সংখ্যালঘু নির্যাতন, ইসলামি চরমপন্থার উত্থান এবং আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলা করতে হলে সরকারকে কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সবার আগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে এবং সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। এর আগে সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে বারবার আশ্বাস দিলেও বাস্তবতা ভিন্ন। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের নির্লিপ্ততার কারণে প্রতিকার বা বিচার পাওয়া যায়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর ভূমিকা না থাকায় এই সমস্যা আরও গভীর হচ্ছে। চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোর বিকাশও একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। গত কয়েক মাসে দ্রুত বিকাশমান চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলো নানামহল থেকে আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছে। এই গোষ্ঠীগুলো ধর্মের নামে সহিংসতা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে তাদের আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে, যা দেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এদের নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারকে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকেও নজর দিতে হবে। চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোর অর্থায়ন ও প্রশ্রয় বন্ধ করতে হবে, তাদের অপপ্রচার ও মিথ্যা প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতে হবে এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহনশীলতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। এছাড়াও, তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে মূলধারায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। শুধু কঠোর আইন প্রয়োগ নয়, বরং সামাজিক ও মানসিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই চরমপন্থার মূলোৎপাটন সম্ভব। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি মোটেও স্বস্তির নয়। খোদ প্রধান উপদেষ্টা কিছুদিন আগে বলছিলেন, দেশ এখন এক ধরনের 'যুদ্ধাবস্থার' মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় সংখ্যালঘু নির্যাতন, ধর্মীয় চরমপন্থার উত্থান এবং আন্তর্জাতিক চাপ দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তুলসী গ্যাবার্ডের সতর্কবার্তা বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের জন্য একটি বার্তা বহন করে। এই সংকট মোকাবিলা করতে হলে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নয়তো, দেশ গভীর সংকটে পড়তে পারে, যা ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলবে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বারবার নির্যাতনের শিকার হলেও এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামোর দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক অভিসন্ধির কারণে এই নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত হবে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। (সূত্রঃ BDNEWS24.com)

Share this article

প্রবন্ধ

প্রবন্ধ বিভাগের সর্বশেষ খবর এবং আপডেট পেতে এই বিভাগে নিয়মিত ভিজিট করুন।

Advertisement

Sidebar Advertisement