Thin-Left
Thin-Right

Advertisement

Top Advertisement
সংখ্যালঘুর অধিকার বঞ্চনা বনাম অস্বীকারের সংস্কৃতি
মতামত

সংখ্যালঘুর অধিকার বঞ্চনা বনাম অস্বীকারের সংস্কৃতি

১৭ জুলাই, ২০২৫
4 মিনিট

লিখাঃ সাইফুর রহমান তপন, সহকারী সম্পাদক, দৈনিক সমকাল

অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার তৎপরতা ও সংখ্যালঘু নির্যাতন বিষয়ে গত ১০ জুলাই বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ এক সংবাদ সম্মেলন করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ জুলাই সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে পুলিশ সদরদপ্ত‌র কিছু বক্তব্য দিয়েছে, যা অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের মতো সমকালেও প্রকাশিত হয়েছে। পুলিশের এ উদ্যোগটি একদিক থেকে ইতিবাচক হলেও অন্যদিকে হতাশাজনক বলে মনে হয়। ১৯৮৮ সালে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত করার পর বাংলাদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা নিজেদের মানবাধিকার রক্ষার সংগ্রামের অংশ হিসেবে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকেই সংগঠনটি নিয়মিতভাবে এখানকার সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। ১০ জুলাইয়ের প্রতিবেদনটি সেই ধারাবাহিক উদ্যোগেরই অংশ। কিন্তু অতীতের কোনো সরকার ওইসব প্রতিবেদনের জবাব দেয়নি; বড়জোর পরিস্থিতি বেশি খারাপ দেখলে তারা ঐক্য পরিষদের প্রতিবেদন নিয়ে কিছু কথা বলত। সেদিক থেকে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যতিক্রম বটে। গত ১১ মাসে প্রকাশিত ঐক্য পরিষদের দুটি প্রতিবেদন নিয়েই তারা কথা বলেছে। বিষয়টি ইতিবাচক এ অর্থে যে, অন্তত নীরবতার চাদর দিয়ে দেশের প্রায় ১০ শতাংশ মানুষের অভিযোগকে চাপা দেওয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে আলোচ্য সংবাদ সম্মেলনে ঐক্য পরিষদ ২৭টি হত্যাসহ গত ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মোট ২৫৮টি ঘটনা তুলে ধরে। পুলিশের মতে, এই সব অভিযোগই ভিত্তিহীন; সাম্প্রদায়িকতার প্রমাণ মেলেনি। এটাকে সেই বহুল চর্চিত ডিনায়াল কালচার বা অস্বীকারের সংস্কৃতি বলে মনে হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অস্বীকার করলেই সংখ্যালঘুদের কষ্টগুলো কি উবে যায়? তারা যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা বদলে যাবে? এটা তো সত্য যে, গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর ঐক্য পরিষদ এক সংবাদ সম্মেলনে ওই বছরের ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত যে ২০১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনার কথা বলেছিল, সেগুলোকেও প্রথমে সরকার অতিরঞ্জন বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। আবার ১৫ জুলাই পুলিশই জানাল, এসব ঘটনা যাচাই-বাছাই করে ৫৬টি জেলায় মোট ১ হাজার ৪৫৭টি ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, পুলিশ বলেছে, ঘটনাগুলোর মধ্যে মোট ৬২টি ঘটনায় মামলা এবং ৯৫১টি ঘটনায় জিডি হয়েছে। এমনকি ৬২ ঘটনায় মোট ৩৫ জনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তাহলে গত সেপ্টেম্বরে অভিযোগগুলো উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল কেন? পুলিশ জানিয়েছে, ঐক্য পরিষদ উত্থাপিত প্রতিটি ঘটনায় তারা সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছে। সব স্থাপনা, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। কিন্তু তাতে কি আস্থা রাখা যায়? সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তারকৃতরা যে এরই মধ্যে জামিনে বেরিয়ে যাননি; কেউ কেউ নতুন কোনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িয়েও পড়েননি, তার নিশ্চয়তা কী? প্রশ্নটা তোলার কারণ, ইতোমধ্যে মব সন্ত্রাস দেশব্যাপী সাধারণ মানুষ, বিশেষত নারী, সংখ্যালঘু, সংস্কৃতিকর্মী, এমনকি সংখ্যাগুরু মুসলিমদের মাজারপন্থি অংশের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ালেও তা বন্ধে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অন্তত দুটি ঘটনার কথা বলা যায়, যেখানে জনমতের চাপে পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করলেও খুব দ্রুত তারা জামিন পেয়ে গেছেন। ঘটনা দুটির একটি গত মার্চের, যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে ‘ওড়না পরা’ নিয়ে হেনস্তার অভিযোগে গ্রেপ্তার প্রতিষ্ঠানটিরই এক কর্মচারী শুধু এক রাতের মধ্যে জামিনই পায়নি, তাকে রীতিমতো ফুলের মালা দিয়ে বরণও করা হয়। অন্য ঘটনাটি সম্প্রতি ঢাকার উত্তরায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদাকে পুলিশের উপস্থিতিতে কতিপয় লোকের হেনস্তা-সংক্রান্ত। ওই ঘটনার হোতারাও মাত্র কয়েক ঘণ্টা পুলিশ হেফাজতে ছিলেন; আদালতে গিয়ে দ্রুত জামিন পান। যেখানে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) গত ১২ জুলাই বলেছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর এখনও পুলিশ বাহিনীর মনোবল দুর্বল, যার ফলে শতভাগ কাজ করতে পারছে না (সমকাল), সেখানে ঐক্য পরিষদের প্রায় আড়াই হাজার অভিযোগ নিয়ে পুলিশ এত দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছল কীভাবে? প্রশ্নটা ওঠে গত ২৬ জুন রাজধানীর খিলক্ষেতে রেলওয়ের জায়গা থেকে একটি অস্থায়ী পূজামণ্ডপ উচ্ছেদ নিয়ে পুলিশের দায়সারা বক্তব্যের কারণে। ঐক্য পরিষদের অভিযোগ ছিল, উচ্ছেদ হয় ‘বিনা নোটিশে’ এবং ‘বুলডোজার দিয়ে বিভিন্ন দেবদেবীর প্রতিমাসহ’ মন্দির গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ উচ্ছেদ অভিযান ‘পুলিশ, সেনাবাহিনী ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে’ রেলওয়ে চালিয়েছে– এটুকু বলেই পুলিশ দায়িত্ব শেষ করেছে। এখানে যে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা হলো, তা কি তারা ধরতে পেরেছে? বগুড়ায় শ্মশানঘাটের পিলার ভাঙার ঘটনায় প্রশাসনের উদ্যোগে শ্মশানঘাট পুনর্নির্মাণ করা হলেই যে ধর্মীয় অনুভূতি রক্ষা হয় না; অপরাধকর্মে জড়িতদের বিরুদ্ধেও আইনগত পদক্ষেপ নিতে হয়; সে ব্যাপারেও পুলিশ সদরদপ্তর নিরুত্তর। সেপ্টেম্বরে ঐক্য পরিষদ অভিযোগগুলো তুলে ধরার পর সরকার ও পুলিশের পক্ষ থেকে চটজলদি বলে দেওয়া হলো, ঐক্য পরিষদ যাদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার বলছে তারা আসলে রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে নাকি তারা জনরোষের শিকার হয়েছে। সেই সময় অনেকেই সরকারি এ ব্যাখ্যাকে দুর্ভাগ্যজনক আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, কোনো সভ্য সমাজেই কোনো অপরাধীর ওপর কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যেমন বিচারের নামে চড়াও হতে পারে না তেমনি কোনো রাজনীতি করলেই কেউ অপরাধী হয়ে যায় না। অতএব, সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে রাজনৈতিক সহিংসতা বলে চালিয়ে দিয়ে সরকার আইনের শাসনকেই বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। দুঃখজনকভাবে, পুলিশের সর্বশেষ বক্তব্যেও একই প্রবণতা স্পষ্ট। বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগে সংখ্যালঘু ধর্ম ও জাতিসত্তার কোনো প্রতিনিধি না থাকার যে অভিযোগ ঐক্য পরিষদ করেছে, সে ব্যাপারেও তো সরকার কোনো সদুত্তর দেয়নি। সাংবিধানিকভাবে কিন্তু এখনও বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সরকারের প্রস্তাব অনুসারে, সংবিধানে ভবিষ্যতে ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে বহুত্ববাদ বসলেও তা সংখ্যালঘুর অধিকার ক্ষুণ্ন করে না। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার যদি সংবিধানে মূলনীতি হিসেবে যুক্ত হয়, তাহলেও সকল ধর্ম ও জাতিসত্তার সমান অধিকার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র বাধ্য। তারা যে আসলেই এসব মূলনীতির প্রতি বিশ্বস্ত– অন্তত তা প্রমাণ করার জন্যও সরকারকে তার পূর্বসূরিদের অস্বীকারের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে সংখ্যালঘুর মানবাধিকার সুরক্ষায় সচেষ্ট হতে হবে।

Share this article

মতামত

মতামত বিভাগের সর্বশেষ খবর এবং আপডেট পেতে এই বিভাগে নিয়মিত ভিজিট করুন।

Advertisement

Sidebar Advertisement