ব্রেকিং নিউজ
ভারত-পাকিস্তানকে ‘ধৈর্য’ ধরতে বললেন জাতিসংঘ মহাসচিব
Thin-Left
Thin-Right

Advertisement

Top Advertisement
মঙ্গল শোভাযাত্রায় অন্তর্ভুক্তির নামে অন্তর্ঘাতমূলক জাত্যভিমান
মতামত

মঙ্গল শোভাযাত্রায় অন্তর্ভুক্তির নামে অন্তর্ঘাতমূলক জাত্যভিমান

২৭ মার্চ, ২০২৫
9 মিনিট

একটি অসরকারি-অরাষ্ট্রীয় উদ্যোগে, তা-ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষদের আয়োজনে সরকার কেন হস্তক্ষেপ করতে মরিয়া হয়ে উঠল?

‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ একটা সংকটে আছে। সংকটটা রাজনৈতিক কারণে যতটা হয়েছে, সাংস্কৃতিক কারণে ততটা হয়নি। সাংস্কৃতিক আধিপত্যটা আগের মতোই রয়ে গেছে। কিন্তু, এই আধিপত্য দলীয় রাজনৈতিক মতাদর্শে নাম লেখানো ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদে’র কাছেই শুধু জিম্মি নেই। লক্ষ করলে দেখা যাবে, খোদ এই জাতীয়তাবাদের বাইনারি হিসেবেই এখানে ‘বাঙালিবাদ’ আরও একটি মারণাস্ত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই আধিপত্যটা ভাঙার চেষ্টা বাঙালির একাত্তরের পরেই করতে পারা দরকার ছিল। সেটা হয়নি। না হওয়ার দরুণ সেটি পরিচয়বাদিতার জায়গা থেকে রাজনৈতিকভাবে ছিনতাই হয়ে গেছে। বিরুদ্ধবাদীরা এটিকে অবশ্য রাজনৈতিক তকমা দিয়েই খারিজ করতে চাইছেন। কিন্তু, তাতে সংকট বাড়ছে বৈ কমছে না। ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদে’র রাজনৈতিক ব্যাটন আওয়ামী লীগের হাতে। ফলে, আওয়ামী লীগ-বিরোধী মাত্রই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে যাবেন, এ আর আশ্চর্য কী! কিন্তু, এতেই কি বাঙালিত্বের সাংস্কৃতিক আধিপত্য নিঃশেষ হয়ে যাবে? যাবে না। কেননা, রাজনৈতিক পরিচিতির ব্র্যাকেটবন্দি ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদে’র বিরোধী পক্ষেরও সিংহভাগ তথা সংখ্যাগুরুর জাতিগত পরিচয় বাঙালি, বিশেষত বাংলাদেশে। ফলে, এই বিরোধীরা যা করেন, সেটিও আসলে সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালিয়ানার ‘বাঙালিবাদ’কেই শক্তিশালী করে। এ রাষ্ট্রে এখন ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদে’র সংকট দশার মধ্যেই অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ‘বাঙালিবাদী’ রাজনীতির পাটাতন দিনকেদিন সর্বময় ক্ষমতাধর হয়ে উঠছে। ২. বাঙালির সংখ্যাগুরু অহমিকা, জাত্যভিমান ও ‘বাঙালিবাদী’ রাজনীতির একটা নিদারুণ উদাহরণ আদিবাসীদের প্রতি বৈষম্য। বাংলাদেশের পাহাড়ে দীর্ঘকাল ধরে এই জাত্যাভিমানের অগণতান্ত্রিক চর্চা আমরা দেখে আসছি। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তথা আদিবাসীদের প্রতি যে আগ্রাসন বাঙালি তার সংখ্যাগুরুর অহমিকাবোধ থেকে জন্ম দিয়েছে, তার ভয়ঙ্কর উদাহরণ বাংলাদেশের সংবিধানে আরোপিত ‘অস্বীকৃতি’, যেখানে তাদের পরিচয় ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’। সাম্প্রতিক সময়ে এই আগ্রাসন খুব পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে এনসিটিবির গ্রাফিতি-কাণ্ডে। পাঠ্যপুস্তকের মলাটে ‘আদিবাসী’ শব্দ-সম্বলিত গ্রাফিতিটি সংযুক্ত করে, তা দঙ্গলের চাপে প্রত্যাহার করে নেওয়ার যে ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছিল, সেটির স্বাভাবিক প্রতিবাদই আদিবাসীসহ আগ্রাসনবিরোধী বিক্ষুব্ধ নাগরিকরা করেছেন। কিন্তু, এর বিরুদ্ধে গিয়ে যে দানবীয় হামলা আদিবাসীদের ওপর চালিয়েছে একটি উগ্রবাদী সংগঠন, তার অসংখ্য ব্যাখ্যা থাকতে পারে, কিন্তু গভীর তলদেশে থাকা উদ্দেশ্যটির একটিই ব্যাখ্যা— বাঙালিবাদী দাপট! সংখ্যাগরিষ্ঠের এমন দানবীয় চরিত্র বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে। আবার, এর বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধও আছে। বাংলাদেশেও আছে। কিন্তু, বাংলাদেশে অভ্যুত্থানোত্তর-পর্বে যেটি অপ্রত্যাশিত ছিল, সেটিই বাস্তবে রূপ দিয়েছে দঙ্গলবাজরা, আদিবাসীদের ওপর ওই হামলা চালিয়ে। এই বৈষম্য এক চলমান প্রক্রিয়া। এই বৈষম্যবাদী চরিত্রের বৈচিত্র্যের শেষ নেই যেন! ৩. বাংলা অঞ্চলে নববর্ষ সমাগত। বাংলাদেশেও ঠিক তাই। পাঠক লক্ষ করুন, এখানে ‘নববর্ষে’র কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু, বলা হয়নি ঠিক কোন নববর্ষের ওপর আলো ফেলা হচ্ছে। নানা জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলনে এই বাংলাদেশ তথা বাংলা অঞ্চল। কিন্তু, শোরগোল শুধু ‘বাংলা নববর্ষ’ নিয়েই। এর পুরোভাগে রয়েছে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বনাম ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’র মুখোমুখি বয়ান। এই বয়ান বহুদিন ধরেই আছে, কিছু চিরায়ত সংস্কৃতিবিরোধী, লোকসংস্কৃতিবিরোধী গোষ্ঠীবাদীদের মধ্যে। কিন্তু, তারা ভুলে যান ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ একটি সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ, কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নয়। তথাপি সেই প্রতিষ্ঠান, যার নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চারুকলা’, তাদের গণআমন্ত্রণে বহু মত-পথের মানুষ এখানে সম্মিলিত হন। যদিও একটি অরাষ্ট্রীয় বা অসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে বহু স্বর ও সুরের যৌথ খামারে পরিণত হওয়া এমন আয়োজনকে বিতর্কিত করার প্রয়াস চলমান। আর বিতর্ক যারা তৈরি করেছেন, তারা এ কথাটিও ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বলতে পারছেন না যে, ‘মঙ্গল’ নাম নিয়ে তাদের ঠিক সমস্যাটা কোথায়, সমাধানইবা কী? উল্টো সমস্যার কথা বলতে গিয়ে একে ‘সাম্প্রদায়িক’ রং দিয়ে বিতর্ক উসকে দিচ্ছেন! এবার সেই বিতর্কে ঘৃতাহুতি দিয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বলা ভালো দিয়েছেন খোদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। সরকারি উদ্যোগ তথা মন্ত্রণালয়ের সরকারি বৈঠক বাদেও, ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে নানাভাবে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মঙ্গল শোভাযাত্রাকে প্রতিস্থাপন করতে জনসম্মতি আদায়ের চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু, জননিন্দা ও সমালোচনার মুখে নাম পরিবর্তনের কূট-উদ্দেশ্য থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। সঙ্গে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ প্রপঞ্চটি যে ইউনেসকোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সেই চাপটিও কাজ করে থাকতে পারে। তবুও, প্রশ্ন থেকে যায়, একটি অসরকারি-অরাষ্ট্রীয় উদ্যোগে, তা-ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগ বা অনুষদের আয়োজনে সরকার কেন হস্তক্ষেপ করতে মরিয়া হয়ে উঠল? কোন অনুপ্রেরণায়? কার বা কাদের প্ররোচনায়? নিজের মনে যা চাইল, ইতিহাসের বাছবিচার না করে তা-ই চাপিয়ে দেওয়ার নাম কি গণতন্ত্র? এজন্য গণমানুষ একটা রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের জন্ম দিয়েছিল? এবার আসা যাক মূল কথায়। মন্ত্রণালয় এবার নববর্ষের আয়োজনে একটি নতুন শব্দ আরোপ করেছে, যে শব্দটা সংবিধান সংস্কার কমিশনের শুরু থেকেই আলোচনা জারি আছে। শব্দটার নাম ‘ইনক্লুসিভনেস’ বা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’। সংস্কৃতি উপদেষ্টা জানিয়েছেন, এবার বর্ষবরণ হবে জাতীয়ভাবে, হবে ‘ইনক্লুসিভ’ এবং অতীতে এরকম কিছু কখনই ঘটেনি! এই ‘অন্তর্ভুক্তি’র মান রাখতে এবার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলন ঘটানো হবে বর্ষবরণের আয়োজনে। চিন্তাটা উদার। কিন্তু, লিবারেলিজম বা উদারনৈতিকতার সমস্যা হলো, সে কোনো কিছুকে ক্রিটিক্যালি পাঠ করতে অক্ষম। কেন? এর উত্তর দেওয়ার আগে আমরা সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া উপদেষ্টার বক্তব্য জেনে নিতে পারি। তাকে উদ্ধৃত করে বিডিনিউজ২৪ডটকম (২৩ মার্চ ২০২৫) লিখেছে, ‘কোনো কোনো সংস্কৃতিকে বা তার জনগোষ্ঠীকে, তার আচারকে, রীতিনীতিকে এক্সক্লুড করাটা সমাজের জন্য মঙ্গলজনক না।’ আচ্ছা, তাহলে বোঝা গেল, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ যেহেতু ‘এক্সক্লুড’ করে ফলে, সে ‘মঙ্গলজনক’ হতে পারে না। স্বভাবতই তাহলে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ ‘ইনক্লুড’ করবে এবং তাতে তা ‘আনন্দময়’ হয়ে উঠবে! সম্পূরক আরেকটি মন্তব্যে উপদেষ্টা বলেছেন (বিডিনিউজ২৪ডটকম, ২৩ মার্চ ২০২৫), ‘এবারের শোভাযাত্রা শুধু বাঙালিদের না। এটা বাঙালি, চাকমা, মারমা, গারো প্রত্যেকের। ফলে আমাদের দেখতে হবে আমরা এমন একটা নাম দেই যেটা আমাদেরই হবে, ওরা যেন ব্র্যাকেটে না পড়ে যায়।’ নাম নিয়ে করা এই মন্তব্যটির ক্ষেত্রে দুটি প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রথমত, উপদেষ্টা সাব্যস্ত করেছেন যে ‘মঙ্গল’ শব্দটা বাংলা শব্দ। তাহলে, ‘আনন্দ’ শব্দটা কোন ভাষার শব্দ? দ্বিতীয়ত, উপদেষ্টা বলছেন নামটা যেন ‘আমাদের’ হয়, ‘ওরা’ তাহলে ব্র্যাকেটে পড়বে না। আশ্চর্য বাগ্মিতা! ‘আমাদের’ বলতে তিনি পরিষ্কার ‘বাঙালিদের’ বোঝাচ্ছেন, আবার তাদের পাশে ‘ওরা’ ব্যবহার করে বাইনারি তৈরি করছেন। ‘আমরা’ ও ‘ওরা’র বাইনারি থেকে যিনি বের হতে পারেন না, তিনি উদার? তিনি ‘অন্তর্ভুক্তি’র পাঠ দেবেন আমাদের? লিবারেল কর্পোরেট চিন্তার মনন দিয়ে কোনো প্রকল্পে হাত দিতে গেলে এমন গুবলেট তো পাকবেই। একই সময়ে সংস্কৃতি উপদেষ্টা আরও একটি মন্তব্য জুড়ে দিয়ে (বিডিনিউজ২৪ডটকম, ২৩ মার্চ ২০২৫) তার ‘ইনক্লুসিভিটি’র আইডিয়া বাজারজাতকরণ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘চাকমারা উৎসবটাকে বলেন বিজু, মারমারা ডাকেন সাংগ্রাই। একটা সেন্ট্রাল নাম থাকলে পরেও ভেতরে যে ব্লকটাতে চাকমাদের শোভাযাত্রা হবে, যে ব্লকটাতে গারোদের শোভাযাত্রা হবে, গারোদেরটার সামনে আপনি ওদের নামটাই দেখবেন ওয়াংগালা, ওদেরটার সামনে সাংগ্রাই।’ এবার নববর্ষ উদযাপন হবে দুই দিনব্যাপী, সরকারি উদ্যোগে। প্রথম দিনটিতে পালিত হবে চৈত্র সংক্রান্তি, দ্বিতীয় দিনটিতে নববর্ষ। সংস্কৃতি উপদেষ্টা যে ইতিহাস ১৯৮০-১৯৯০ সাল থেকে হিসাব করা শুরু করেছেন, তার মধ্যেই একটা শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। যে কারণে তিনি ইতিহাসের পারম্পর্য বুঝতে অক্ষম। সরকার সাধারণ বৈশ্বিক নাগরিকপঞ্জী (গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার) অনুযায়ী হিসাব করেছে ১৩ এপ্রিল চৈত্র সংক্রান্তি, ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী (১৫ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ) এ হিসাব ভ্রান্ত, সেটি মিলে না এবং বহুদিন ধরেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র এই ভ্রান্তি নিয়েই ‘সামঞ্জস্য বিধান’ করে চলেছে। সূর্য-চন্দ্র তথা সৌর কিংবা চন্দ্র বর্ষপঞ্জির মতো প্রাকৃতিক বিষয়ে যে রাষ্ট্রীয় খবরদারি চলে না, তা রাষ্ট্র বোঝেনি, অন্তত চন্দ্রের ক্ষেত্রে বুঝলেও, সৌর বর্ষপঞ্জির ক্ষেত্রে একদমই বোঝেনি। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ যদিও, কিন্তু ‘ইনক্লুসিভিটি’র জায়গা থেকেও এ হিসাব বাতিল হতে বাধ্য। এই যে সরকারি উদ্যোগ, সেখানে প্রধান ভ্রান্তিগুলো নিয়ে এক এক করে আলোচনা করা যাক। সরকার আয়োজন করছে ‘নববর্ষ ১৩৩২’, যেটি বাংলা বর্ষপঞ্জির হিসাবে বলা অংক। চাকমাদের সঙ্গে এ বর্ষগণনা মিলবে না, কেননা তারা বঙ্গাব্দ অনুসরণ করলেও, তাদের মূল হিসাব হয় পঞ্জিকা দিয়ে। মারমাদের ‘মাহা সাংগ্রাই পোয়ে’ উৎসবটিও এই সময়েই শুরু হয়। তাদের বর্ষপঞ্জির নাম ‘ম্রাইমা সাক্রঃয়’। এখন চলছে তাদের ১৩৮৬ সাল। ত্রিপুরাদের বর্ষপঞ্জি ‘ত্রিপুরাব্দ’ বা সংক্ষেপে ‘ত্রিং’। এখন চলছে ১৪৩৪ ত্রিপুরাব্দ। তার মানে ‘বর্ষবরণ ১৪৩২’ উল্লেখ করে প্রকৃতপ্রস্তাবে রাষ্ট্র শুরুতেই এ দেশের জাতিগত ‘সংখ্যালঘু’দের ‘অপর’ করে দিয়েছে। এবার আসা যাক, সময়ের তারতম্যে। মনে রাখতে হবে, এগুলোর হিসাব সূর্যকে সাক্ষী মেনে করা হয়। চাকমাদের উৎসব চলে তিন দিন। বঙ্গাব্দের পঞ্জিকা (রাষ্ট্র প্রদত্তটি নয়) অনুযায়ী চৈত্র সংক্রান্তি ১৪ এপ্রিল, সেদিন চাকমারা পালন করে ‘মূল বিজু’, আগের দিন অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল ‘ফুল বিজু’ এবং তৃতীয় দিন তথা ১৫ এপ্রিলের নববর্ষের দিন হলো ‘গোজ্যেপোজ্যা বা গইজ্যাপইজ্যা’। এই তিনদিনের আয়োজন ‘বিজু’ হিসেবে পরিচিত বা জনপ্রিয়। তঞ্চঙ্গ্যারা এই আয়োজনকেই বলে ‘বিষু’। মারমাদের সাংগ্রাই চলে ১৩ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত। ত্রিপুরাদের বৈসুক (বা বৈসু) বঙ্গাব্দের চৈত্র সংক্রান্তিতে তথা ১৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানগুলোর আদ্যক্ষরকে সাজিয়ে বাঙালি শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্ত নাম দিয়েছে ‘বৈসাবি’ (বৈসুক-সাংগ্রাই-বিজু/বিষু) এবং এই শাব্দিক কৌশলের কারণে ‘বৈসাবি’কে বাঙালিরা আদিবাসীদের একটি ‘স্বতন্ত্র’ উৎসব মনে করে। অথচ, বাস্তবে অস্তিত্বহীন এমন ধারণার সঙ্গে আদতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কোনো সম্পর্কই নেই। কেননা, উল্লিখিত এই সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু এই তিন-চারটি জাতিগোষ্ঠীরই উৎসব পালিত হয় না। ১১টি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বম, পাংখোয়া ও লুসাই জাতি ব্যতীত বাকিরা এ সময়ে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের অনুষ্ঠান পালন করে। মারমাদের এ আয়োজনকে সাংগ্রাই বলে। রাখাইন ও চাকরা বলে সাংগ্রাই। ম্রোরা বলে চাংক্রান। খিয়াংরা একে সাংলান বা খুমীরা সাংক্রাইং বলে। অহমিয়ারা বলে বিহু, সাঁওতালরা বলে পাতা। (বিডিনিউজ২৪ডটকম, ১৩ এপ্রিল ২০২৪) বোঝা যাচ্ছে, শুধু ‘বৈসাবি’ বলে বাঙালিরা যাকে আখ্যা দিয়েছে, তার ভিত্তি খুবই দুর্বল। আরেকটি বিষয় বোঝা যাচ্ছে, বঙ্গাব্দের যে ‘সংক্রান্তি’ শব্দ ও এটি পালনের যে আইডিয়া, আদিবাসীদের ব্যবহৃত শব্দ ও উৎসবগুলোও প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ের আইডিয়া ধারণ করে। মূলত কৃষি-ভিত্তিক সমাজের সঙ্গে এই সময়ের উৎসবের ব্যাপক সম্পর্ক লক্ষ করা যায় এবং কোনো কোনো জাতিগোষ্ঠীর ফসল ঘরে তোলার সঙ্গে ব্যাপারটি সম্পর্কিত। বর্ষবরণের সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রায় অন্তর্ভুক্তির নামে অন্তর্ঘাতমূলক জাত্যভিমানের প্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে এবারের পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনকে ‘স্বজনপ্রীতিদুষ্ট ও দেশের পরিবর্তনকালীন সময়ে রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী’ আখ্যায়িত করে এ আয়োজন ও আয়োজক কমিটিকে বর্জনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন চারুকলার ২৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। চারুকলায় প্রতিবছর আনুষ্ঠানিকভাবে নির্দিষ্ট ব্যাচের তত্ত্বাবধায়নে এবং সম্পূর্ণভাবে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের যৌথ প্রয়াসে আয়োজিত হয়ে থাকে মঙ্গল শোভাযাত্রা। যে আয়োজনের সম্পূর্ণ অর্থ অনুষদের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের শিল্পকর্ম বিক্রির মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। চারুকলার রীতি অনুযায়ী এ বছরের আয়োজন ২৬ ব্যাচের তত্ত্বাবধানে হওয়ার কথা। ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বড় বড় মেট্রোপলিটনে নাগরিক মধ্যবিত্ত চৈত্র সংক্রান্তির চেয়ে নববর্ষের দিনকে বেশি প্রাধান্য দেয়। কলকাতা-কেন্দ্রিক নাগরিক মধ্যবিত্তদের ঘরে ঘরে সংক্রান্তি পালন হলেও ঢাকায় বর্ষবরণই আসলে এ সময়ের মূল অনুষ্ঠান। যান্ত্রিক ও ব্যস্ত নগরজীবনে আর কীইবা করার আছে, ছায়ানট কিংবা চারুকলার বর্ষবরণের আয়োজনকে মহামিলনে পরিণত করা ছাড়া! সে যাই হোক, আমাদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের স্বপ্ন দেখানো রাষ্ট্র ও নতুন করে সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক পাঠ শেখানো তার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় যে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগ’ গ্রহণ করতে যাচ্ছে এবারের বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে, তা বাঙালি আধিপত্যের আরেকটি ‘যুগান্তকারী উদ্যোগ’ ছাড়া আর কিছুই নয়। যে দিন-ক্ষণ নির্ধারণ করে রাষ্ট্র বর্ষবরণকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে জাতীয়করণ করতে চাইছে, সেই দিন-ক্ষণের সঙ্গে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিপালিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, প্রথা ও পারম্পর্য পালনের দিন-ক্ষণের কোনো মিল নেই। উল্টো যা আছে, তা হলো তাদেরকে তাদের ঐতিহ্য ভুলিয়ে দেওয়ার এবং তাদের ঐতিহাসিক পরম্পরার জমিন (স্পেস) ছেড়ে দিতে বলার এক (অ)দূরদর্শী প্রকল্প। বাংলাদেশ রাষ্ট্র বঙ্গাব্দের হিসাব করতে পঞ্জিকার মতো বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির অনুশাসন মানে না, বাকি জাতিগোষ্ঠীদেরও মানতে বাধ্য করার পাঁয়তারা করছে এখন। ফলে, রাষ্ট্রের এ ‘অভূতপূর্ব’ আয়োজনকে বিশেষ খাতির করার কোনো কারণ নেই। বাঙালিবাদী প্রকল্পের মধ্যে অবাঙালিদের গায়ের জোরে প্রবেশ করানোর চেয়েও জরুরি প্রশ্ন আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান এবং তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, নিজস্ব সংস্কৃতিকে স্বতন্ত্র ও স্বকীয় রাখতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা। তাদের উৎসবের দিনগুলোতে রাষ্ট্রীয় ছুটি প্রদান করা কিংবা কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মসূচি না রাখা। এবার ১৫ এপ্রিল এসএসসি পরীক্ষা রাখা হয়েছে। পুরো দেশের জন্যই যদি এ উৎসবকে জাতীয়করণ করা হয়, তাহলে বাঙালি-আদিবাসী সবার জন্যই এ সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয় কমিটমেন্টের বরখেলাপ। উৎসবের সময়ে পরীক্ষা ফেলার দ্বিচারিতা কেন? ৫. রাষ্ট্র উদারীকরণের মধ্য দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে চায়। কিন্তু, তার মনের অন্দরের সুশীল-মধ্যবিত্ত-কর্পোরেট প্রকল্পের পাঠটিকে যদি আমরা বুঝতে না পারি, তাহলে এই লিবারেলিজমের ফাটকা বুলিটি আমরা ধরতে সক্ষম হব না। উদারীকরণের আবেগের তলে রাষ্ট্রের বহু উদ্যোগ জায়েজ বলে চালিয়াতি করা হয়। এ উদ্যোগের রেশ হিসেবেই রাষ্ট্রে বসবাসরত ‘সংখ্যালঘু’ জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র স্বর ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উপেক্ষিত থাকে। বহুত্ববাদী লিবারেল রাষ্ট্রের এও এক জালিয়াতি, যেখানে সবকিছুই ধোঁয়াসচ্ছন্ন রাখা যায়, কিন্তু মূল উদ্দেশ্যটি কর্পোরেট ব্যবসার দাসত্ব গিলতে মোটেও কার্পণ্য করে না। রাষ্ট্রের এ কর্পোরেট প্রেসক্রিপশনে জেগে ওঠা বর্ষবরণ প্রকল্পকে তাই সন্দেহ করা জরুরি। সংখ্যাগুরুর জাত্যাভিমানের লেন্স দিয়ে যা দেখা হয়, তাকে সন্দেহ ও চ্যালেঞ্জের চোখ দিয়েই দেখতে হবে আমাদের। ‘বাঙালিবাদী’ সংখ্যাগুরুর জাত্যাভিমানের বয়ানকে রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেই আমাদের চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে। লিখকঃ সৌমিত জয়দ্বীপ (সূত্রঃ BDnews24.com)

Share this article

মতামত

মতামত বিভাগের সর্বশেষ খবর এবং আপডেট পেতে এই বিভাগে নিয়মিত ভিজিট করুন।

Advertisement

Sidebar Advertisement