জাতীয়
আমাদের ধনখড়েরাও অপমানিত হয়ে অপসারিত হয়েছিলেন সালেহ উদ্দিন আহমদ
৫ আগস্ট, ২০২৫
7 মিনিট
প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় এক কলামে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড় কী পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেছেন, তার বিস্তারিত লিখেছেন।
প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় এক কলামে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড় কী পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেছেন, তার বিস্তারিত লিখেছেন। সৌম্য লিখেছেন, এভাবে অসম্মানিত অপসারণ আরও ভয়ংকরভাবে এই বার্তা ছড়িয়ে দিল, ‘কর্তার’ রোষানলে পড়লে কারও রেহাই নেই। এই বার্তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক আগেই প্রচারিত হয়েছিল। আমাদের দেশেও ধনখড় ছিল। অনেকে হয়তো জানেন না বা ভুলে গেছেন, আমাদের ধনখড়দেরও অনেক অসম্মান করে বিদায় দেওয়া হয়েছিল। তবে ‘কর্তার’ ইচ্ছায় নয়; বরং দুই ‘কর্ত্রীর’ ইচ্ছায়। সেসব ঘটনা ভারতের ধনখড়ের চেয়েও চমকপ্রদ এবং রাজনীতির নাটকে ভরপুর।
ধনখড় একসময় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন। সে সময়টায় রাজ্যের রাজনীতিতে তাঁর অতি সক্রিয়তা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অতিষ্ঠ করে তোলে। নিয়তির কী উপহাস, মোদি তাঁকে উপরাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারণের একটা বড় কারণ ছিল ‘তাঁর অতি সক্রিয়তা’। অন্য বড় কারণটা ছিল ‘প্রটোকলের বিষয়ে স্পর্শকাতরতা’। আশ্চর্য এক মিল-বাংলাদেশের ধনখড়দের অপমান ও অপসারণের কারণও ছিল ঠিক এই দুটি।
বাংলাদেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ‘অতি সক্রিয়তা’ ও ‘প্রটোকলের বিষয়ে স্পর্শকাতরতা’ নিয়ে সুপ্রিম নেতাদের দেওয়া লাইনটা কিছুটা ‘অতিক্রম’ করেছিলেন। প্রতিক্রিয়া ছিল তৎক্ষণাৎ, তাঁদের অপমানিত হয়ে চাকরি হারিয়ে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। এই দুটি ঘটনা একসময় দেশের রাজনৈতিক আলোচনায় দারুণ ঝড় তুলেছিল।
২.ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাবা কফিল উদ্দিন চৌধুরী ছিলেন তুখোড় রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের একজন বরেণ্য নেতা। ১৯৭২ সালে বাবার মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ চেয়েছিল বদরুদ্দোজা চৌধুরী বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করবেন। কিন্তু তিনি তা চাননি। তিনি একজন শীর্ষ স্থানীয় মেডিকেল শিক্ষাবিদ ও চিকিৎসক হিসেবে নিজে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁর উপস্থাপনায় অনুষ্ঠান ‘আপনার ডাক্তার’ ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়।
১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নেওয়ার পর তিনি জিয়ার উপদেষ্টা হন। পরে রাষ্ট্রপতি জিয়া যখন নিজের রাজনৈতিক দল গঠন করেন ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী হলেন দলের মহাসচিব। সবাই আশ্চর্য হয়ে গেলেন। যে মানুষটা রাজনীতিকে এত কাছ থেকে দেখার পরও রাজনীতি থেকে এতটা বছর দূরে ছিলেন, হঠাৎ কেন রাজনীতিতে যোগ দিলেন ?
খালেদা জিয়া হয়তো মনে করতেন, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর বি চৌধুরী তাঁকে যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করতেন না। রাষ্ট্রপতির প্রটোকলের প্রতি অবিচল থাকায় চরম শাস্তি পেতে হলো বি চৌধুরীকে। তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে দেওয়া হয়নি, প্রধানমন্ত্রী একটিবার তাঁর সঙ্গে কথা বললেন না। এই অপমান ধনখড়ের অপমানের চেয়ে কম নয়।
রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে বি চৌধুরীর খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জিয়া খুব বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা করতেন বি চৌধুরীকে। জিয়ার মৃত্যুর পর একসময় খালেদা জিয়া বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। দলে ও খালেদা জিয়ার সরকারে বদরুদোজ্জা চৌধুরী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপি তাঁকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর আইন অনুযায়ী তিনি মন্ত্রিত্ব ও বিএনপির সব দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি নেন।
বঙ্গভবনে যাওয়ার পর বি চৌধুরী সরকার ও দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তিনি রাষ্ট্র ও প্রেসিডেন্সিকে দলের ওপরে স্থান দিতেন এবং প্রেসিডেন্সির স্বাধীন সত্তা ও প্রটোকল বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। দলের ভেতরে এর মধ্যে বিএনপি নেতা সাইফুর রহমান, অলি আহমদ, মতিন চৌধুরী হয়ে ওঠেন খালেদা জিয়ার পরামর্শদাতা। তাঁরা দলের বাইরে বি চৌধুরীর স্বাধীন সত্তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কান ভারী করতে থাকেন বলে আলোচনা আছে এবং দলের সংসদ সদস্যদেরও তাঁরা খেপিয়ে তোলেন। নিজের জন্য আলাদা ইমেজ গড়ে তোলার চেষ্টাই তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
দলের পার্লামেন্টারি বোর্ডে তৎপরতা শুরু হয় তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরাতে। অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সম্মতিতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০ জুন, ২০০২ তারিখে অনুষ্ঠিত বিএনপির সংসদীয় দল বৈঠক করে বি চৌধুরীকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেয়। পদত্যাগ না করলে কী শাস্তি, সেটা সবার জানা ছিল। পরবর্তী সময় বদরুদোজ্জা চৌধুরী পদত্যাগ করে রাষ্ট্রপতি ভবন ছাড়লেন।
রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বি চৌধুরীর পদত্যাগের পর বিবিসির সংবাদে বলা হয়, ‘জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর সমাধিতে ড. চৌধুরীর অনুপস্থিতি এবং মৃত্যুবার্ষিকীতে দেওয়া এক বার্তায় জিয়াউর রহমান যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, তা না বলায় বিএনপি নেতারা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।’
খালেদা জিয়া হয়তো মনে করতেন, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর বি চৌধুরী তাঁকে যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করতেন না। রাষ্ট্রপতির প্রটোকলের প্রতি অবিচল থাকায় চরম শাস্তি পেতে হলো বি চৌধুরীকে। তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে দেওয়া হয়নি, প্রধানমন্ত্রী একটিবার তাঁর সঙ্গে কথা বললেন না। এই অপমান ধনখড়ের অপমানের চেয়ে কম নয়।
৩.বাংলাদেশের সাবেক বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, যিনি এস কে সিনহা নামে বেশি পরিচিত, তাঁর ‘ধনখড় হওয়ার’ কাহিনিও কম চমকপ্রদ নয়। তিনি ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন।
এস কে সিনহা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিলেন। তাঁকে প্রধান বিচারপতি করার পর কলকাতার বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা ২৫ মার্চ ২০১৬ সালে প্রথম পাতায় এক নিবন্ধ প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল-‘বাংলাদেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি সুরেন্দ্র কুমার?’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আবার সাধারণ নির্বাচন ২০১৯ সালে। তার আগেই বর্তমান রাষ্ট্রপতি হামিদের মেয়াদ ফুরানোর কথা। সেই শূন্য আসনে সুরেন্দ্র কুমারকে বসানোর সুযোগ ছাড়বেন কেন হাসিনা। বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ প্রমাণ করার সুযোগ তাঁর সামনে। সুরেন্দ্র কুমারও সেই ইঙ্গিত পেয়েছেন। তার জোরেই রাষ্ট্রীয় গরিমা প্রকাশে তিনি ব্যস্ত। সিলেটের সভায় তিনি বলেছেন, আমেরিকার ডলার যার, গণতন্ত্র তার। বাংলাদেশে তা নয়। এখানে সবাই সমান।’
তখন কি তিনি জানতেন ‘এখানে সবাই সমান’ যতক্ষণ ‘সবাই’ দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির সব কথামতো চলবেন। বিচারপতি সিনহা হাসিনা সরকারের উপদেশ মেনে সব বিচারব্যবস্থা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আপিল বিভাগের যে বেঞ্চ বাতিল করেছিল, এস কে সিনহা ছিলেন তার অন্যতম সদস্য।
কিন্তু ‘অতি সক্রিয়তা’ দেখিয়ে একটা ব্যাপারে তিনি সরকারের বিরোধিতা করলেন। এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন। এর ফলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অসদাচরণ তদন্ত ও অপসারণের সুপারিশ করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতেই ফিরে আসে।
ক্ষমতাসীনেরা বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা তাঁদের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন, যাতে করে তাঁরা বিচারপতিদের হাতের মুঠোয় রাখতে পারেন। হাসিনা সরকার এ কে সিনহার অতি সক্রিয়তা ও অবাধ্যতা হিসেবে দেখল। তাঁর ওপর নেমে আসে অপমান ও হুমকির খড়্গ।
এস কে সিনহা ডেইলি স্টারকে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কয় দিন আগে, ৩১ জুলাই তারিখে। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে আমার শেষ দিনগুলো ছিল খুবই ভয়ংকর, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এটা কেবল উপলব্ধি করা যায়। আমি প্রধান বিচারপতি ছিলাম, আমাকেই গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। আমাকে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। আমার ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। আমার বাড়ির চারপাশে নিরাপত্তা বাহিনী (গোয়েন্দারা) পাহারা বসায়। আমার একজন স্টাফ বাসায় ঢুকতে গেলে তাকে পেটানো হয়। ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন প্রধান সাইফুল আবেদীন মধ্যরাতে আমাকে বিরক্ত করতেন এবং পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার জন্য চাপ দিতেন।’
এ অবস্থার মধ্যেই ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর রাতে ঢাকা ত্যাগ করেন বিচারপতি সিনহা এবং পরবর্তী সময় পদত্যাগ করেন।
সিনহা ঘটনার আরেক খলনায়ক ছিলেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিঞা। তিনি ছিলেন তৎকালীন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি, তিনি অন্য সব বিচারপতিকে রাজি করান, তাঁরা যেন এস কে সিনহার সঙ্গে আদালতে না বসেন। তাঁকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, সিনহার পর তাঁকেই প্রধান বিচারপতি করা হবে। যদিও তিনি কিছুদিন অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি ছিলেন, তাঁকে বাদ দিয়ে নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার পর ওয়াহাব মিঞা সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করেন।
৪.আমাদের দেশেও যাঁরা নেতৃত্বের শীর্ষে থাকেন, তাঁরা একটা জিনিস একদম পছন্দ করেন না এবং তা হলো ‘অবাধ্যতা’। গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে বা পদ বজায় রাখতে সুপ্রিমলিডারকে মান্য করে টিম প্লেয়ার হয়ে শিশুর মতো বাধ্য থাকতে হবে।
নিচের নেতারা তাঁদের দেওয়া দায়িত্ব ও প্রত্যাশার বাইরে কাজ করবেন, সুপ্রিম নেতাদের তা কখনো পছন্দ নয়। আর আমাদের দেশে যাঁরা দলের সুপ্রিম নেতা, তাঁরা ছাড়া অন্য কারও কোনো বাড়তি প্রটোকল নেই, সবাই মোটামুটি সমান। এই নিয়ম শেখ মুজিব, জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা তাঁদের ক্ষমতার সময় শক্তভাবে প্রয়োগ করেছিলেন। সব দলের নেতা-কর্মীরাও বিষয়টি ভালোভাবে জানতেন, তাই খুব হুঁশিয়ার থাকতেন।
তবু মাঝেমধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। বি চৌধুরী ও এস কে সিনহা ছাড়াও আরও অনেক রাজনৈতিক নেতাকে তাঁদের ‘বিচ্যুতির’ জন্য বিরাট মূল্য দিতে হয়েছিল, কারও কারও রাজনৈতিক কর্মজীবনে তালা লাগাতে হয়েছিল। তাঁদের কয়জন হলেন আওয়ামী লীগের ড. কামাল হোসেন, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল জলিল এবং বিএনপির আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও মেজর হাফিজ। বিএনপির সেক্রেটারি আবদুল মান্নান ভূঁইয়াকে বহিষ্কার করার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৫০ জন সাবেক সংসদ সদস্য দলের রোষানলে পড়েন।
সালেহ উদ্দিন আহমদ লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক