নারী এবং সংখ্যালঘুদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা

18

[৩০ মে এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভলেপমেন্ট (এএলআরডি) ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ যৌথভাবে আয়োজিত ‘নারী এবং সংখ্যালঘুদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা’ বিষয়ক ওয়েবিনারে এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা উপস্থাপিত আলোচনাপত্র। ]
১. ভূমিকা:
নারী এবং জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকার, বঞ্চণা ও নিরাপত্তা বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত। দেশভাগের পর পাকিস্তান সরকার আমলেও ভূমির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে কোনো টেকসই ও সমতাভিত্তিক সংস্কারের উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। বরং, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সম্পত্তিকে কালো তালিকাভুক্ত করে শত্রæ সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির মাধ্যমে এক লক্ষেরও অধিক পাহাড়ি আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিজ ভিটে-মাটি হারিয়ে পাশর্^বর্তী দেশে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার পর নারী, সংখ্যালঘুসহ সকল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে ভূমি ও কৃষি খাতের আমূল পরিবর্তনের জন্য বঙ্গবন্ধুর সদিচ্ছা এবং নির্দেশনা থাকা সত্তে¡ও নানাকারণে পরবর্তীতে সেটা আর সম্ভব হয়নি।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘ছোট ছোট চাষীদের অবশ্যই উৎপাদনক্ষম করে তুলতে হবে। একথা মনে রেখে আমরা পল্লী এলাকায় সমবায় ব্যবস্থার ভিত্তিতে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করতে চেষ্টা করছি। এর ফলে চাষীরা কেবলমাত্র আধুনিক ব্যবস্থার সুফলই পাবে না বরং সমবায়ের মাধ্যমে সহজ শর্তে ও দ্রæত ঋণ পাওয়া সম্ভব হবে। এই সাথে আমাদের উদ্দেশ্য হলো ভূমিহীন ও স্বল্প জমির অধিকারী চাষীদের জন্য ব্যাপক পল্লী পুনর্গঠনের কর্মসূচি গ্রহণ করা।’ (সূত্র: ২৬ মে মার্চ ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ জাতির উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর বেতার ভাষণ)।
ক্রমান্বয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, তথাকথিত উন্নয়নমূলক কর্মকাÐ এবং অপরিকল্পিত ভূমি ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন প্রান্তিক কৃষক ভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছেন, অন্যদিকে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। ফলে, যে একসময় নিজ জমিতে চাষ করতো, এখন সে অন্যের জমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। আবার অনেকে, পেশা পরিবর্তন করে শহরে এসে বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজের সাথে যুক্ত হচ্ছেন। দেশে কর্মরত শ্রমশক্তির ৯৫ দশমিক ৪ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক যার ৪০.৬ শতাংশ নিয়োজিত আছে কৃষি খাতে।বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ প্রতিবেদন থেকে এ চিত্র পাওয়া গেছে। কৃষির মূল উপকরণ জমি হলেও প্রকৃত কৃষকের হাতে জমির মালিকানা নেই।পরিসংখ্যান বলছে ৮০ ভাগ জমির মালিকানা রয়েছে ২০ ভাগ মানুষের হাতে যারা উৎপাদনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নন, অন্যদিকে কৃষি নির্ভর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর হাতে রয়েছে যত সামান্য জমি যাদের অধিকাংশই আবার ভূমিহীন। অনুপস্থিত ভূ-স্বামীদের হাতে কৃষিজমির মূল মালিকানা রেখে কৃষি ও কৃষকের প্রকৃত উন্নয়ন বরাবরই প্রশ্নসাপেক্ষ। আর, ভূমির মালিকানা খÐবিখÐ হওয়ায় ভূমিহীনতার প্রাদুর্ভাব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। একই সাথে কৃষি জোতের আয়তন হ্রাস পেয়েছে, মাঝারি এবং ক্ষুদ্র কৃষক প্রান্তিক কৃষকে পরিণত হয়েছে। তদুপরি কিছু বৈষম্যমূলক উপনিবেশিক ও ধর্মীয় আইন, প্রাতিষ্ঠানিক বিধিবিধান, যেমন অর্পিত সম্পত্তি আইন, পারিবারিক উত্তরাধিকার আইন, আদিবাসীদের প্রথাগত সম্পত্তির স্বীকৃতি না থাকা এগুলো ভূমিগ্রাসী স্বার্থন্বেষী মহলের জন্য সহায়ক হয়েছে।
এটা লক্ষ্যণীয় যে বর্তমান সরকার দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। তবে ১৯৫০ সালের বঙ্গীয় প্রজাসত্ত¡ আইনের মাধ্যমে ভু-সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার পর এদেশে আর কোনো বড় ধরনের ভূমি বা কৃষি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যদিও বিভিন্ন নির্বাচনকালীন সময়ে প্রকাশিত ইশতেহারে ভূমি ও কৃষি সংস্কারবিষয়ক বিভিন্ন প্রতিশ্রæতি ও অঙ্গিকারে উল্লেখ আছে। এসব সত্তে¡ও, বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রিতা এবং জটিলতার কারণে এদেশের দরিদ্র প্রান্তিক জনগণ বিশেষ করে নারী, সংখ্যালঘু, আদিবাসীদের ভূমি অধিকার সুরক্ষিত তো হয়নিই বরং তারা আরও প্রান্তিকতায় চলে গেছে। প্রবৃদ্ধিমুখী উন্নয়ন দর্শন আর বিশ^ায়নের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থার অনুপ্রবেশ দেশের অভ্যন্তরে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী, প্রভাবশালী, ভূমিগ্রাসী মহল তৈরি করেছে। যারা নিজেদের অর্থনৈতিক ফায়দা লুটের জন্য রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ও পেশিশক্তির জোরে এবং প্রচলিত আইনের ফাঁক গলিয়ে সাধারণ, প্রান্তিক মানুষের ভূমি জবরদখল করছে। এবং প্রান্তিক মানুষের নিঃস্বায়নকরণ প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান ক্রমান্বয়ে কমে এলেও খাদ্য উৎপাদনের জন্য দেশের মোট আয়তনের প্রায় ৬০ শতাংশ জমি আবাদ করতে হয়। এই ভূমিহীন, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকরাই আমাদের খাদ্যশস্য উৎপাদন কর্মকাÐ এবং সুরক্ষার প্রধান চালিকাশক্তি। এদের মধ্যে যাদের নিজেদের জমি আছে তারা সেখানেই চাষাবাদ করে, অধিকাংশই অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে অথবা শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। বিশ^ব্যাংকের সংকলিত উন্নয়ন সূচক ২০১৮ প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ০.০৪৮১৭ হেক্টর । পরিকল্পনা কমিশনের পরিসংখ্যান ও তথ্য বিভাগের কৃষি শুমারি ২০১৯- এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে দেশে মোট খানার মধ্যে ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা ১১ দশমিক ৩৪ শতাংশ, অর্থাৎ তাদের নিজেদের কোনো ধরনেরই জমি নেই। এ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৮ সালে ভূমিহীনতার হার ছিলো ১২ দশমিক ৮৪ শতাংশ; ১৯৯৬ সালে ছিলো ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ, এবং ১৯৮৩ সালে ছিলো ৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
একবিংশ শতকের শুরু থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উন্নয়নের লক্ষ্যে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিকিকরণকে গুরুত্ব দিয়ে ক্রমান্বয়ে জমির বিভাজন ঘটছে। দূর্বল আইনের সুযোগে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাপকহারে পাহাড়, বনভূমি, কৃষিজমি, বসতভিটা দখল হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভূমি জলা-পাহাড়-জঙ্গল গ্রাসের সাথে যুক্ত রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উন্নয়ন ও বাণিজ্য সংস্থা। এসব সংস্থা ভূমিসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করে একদিকে যেমন কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ করছে, আবার, শিল্পায়নের জন্য সরকারি অধিগ্রহণের ফলে নিজ ভিটে-মাটি হারাচ্ছেন পাহাড়-সমতলের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ অসহায় দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষ। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন ধ্বংস করে পর্যটন ও উন্নয়নের নামে পাহাড় দখল, ভূমি অধিগ্রহণ, রিজার্ভ ফরেস্ট, ইত্যাদি কারণে পাহাড়ী আদিবাসীরা তাঁদের আদি নিবাস থেকে উচ্ছেদ হচ্ছেন। ফলে জুমচাষ নির্ভর পাহাড়ি আদিবাসীদের জীবন জীবিকার পরিসর সংকুচিত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিবার নতুন জরিপের সময় বাংলাদেশের সমতলের বিভিন্ন জেলাগুলোতে বসবাসকারী অনেক আদিবাসীদের জমি সরকারি খাসজমি হিসেবে রেকর্ড হয়ে গেছে।
ভূমি প্রশাসনের এক শ্রেণির অসাধু কর্মচারীদের সহযোগিতায় ভূমিগ্রাসীরা জাল কাগজপত্র তৈরি করে সমতলের কৃষিনির্ভর আদিবাসীদের জমি জবরদখল করছে। ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদকল্পে অসহায় এ মানুষদের ঘর-বাড়িতে আগুন দেয়া হচ্ছে, লুটপাট করা হচ্ছে, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি, এমনকি পরিবারের নারী সদস্যকে ধর্ষণ, গুম এবং খুন পর্যন্তও করা হচ্ছে। বিঘিœত হচ্ছে তাদের জীবন ও মালের নিরাপত্তা। সাম্প্রতিক সময়ে বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে ম্রো আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে তাঁদের জায়গা দখল করে পাঁচতারকা হোটেল নির্মাণের উদ্যোগ এবং সমতলের গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সুগারমিল কর্তৃক সাঁওতালদের ভূমি দখলের ঘটনাটি বৈষম্য ও বঞ্চনার জ¦লন্ত উদাহরণ। উন্নয়নের মূলধারায় দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া দরিদ্র ও প্রান্তিক নারী, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ভূমিহীন কৃষকের অন্তর্ভূক্তি টেকসই উন্নয়নের অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য খুবই যুক্তিযুক্ত।
ভূমি ও কৃষিতে নারীর অধিকার- নীতিমালা ও আইন বাস্তবায়নে বর্তমান চ্যালেঞ্জ:
বাংলাদেশের সংবিধানে নারী পুরুষের সমতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু, আমাদের সমাজে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদ অর্জনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয়। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে আমাদের সার্বজনীন কোনো আইন নেই। এমনকি আদিবাসীদের ভূমি বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রথাগত নিয়ম অনুসরণ করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীরা সম্পত্তি পায় না।
এদেশে ভূমি এবং উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ওপর নারীদের কোনো কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নেই। নেই কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না তৎকালীন ভারতবর্ষে ক্ষেতমজুর, ভূমিহীনদের ভূ-সম্পদের আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো একটি পূর্ণাঙ্গ ভূমি ও কৃষি সংস্কার; যেখানে সকল ভূমিহীন কৃষক, বিশেষ করে নারী ও আদিবাসীদের ক্ষমতাভিত্তিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে। ইলা মিত্র, কুমুদিনী হাজং, রাশমনি হাজংয়ের সংগ্রামী চেতনায় রচিত হয়েছে এদেশের ভূমি আন্দোলন। কিন্তু, আজও একইভাবে নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এ দেশে।
এশিয়ার অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও কৃষিকাজ মূলত গ্রামীণ জীবন ও জীবিকার অন্যতম প্রধান উপায়, যেখানে নারীর অবদান পুরুষের সমান, আবার অনেক ক্ষেত্রে তা অতিক্রমও করে। সরকারি তথ্যানুযায়ী ৭২.৬ শতাংশ নারী কৃষিকাজের সাথে জড়িত। অথচ, ভূমিতে তাঁদের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা মালিকানা নেই এবং কৃষক হিসেবেও তাঁরা স্বীকৃত নয়। ফলে তাঁরা অধিকতর ও বহুমাত্রিক দারিদ্রতার শিকার। এদেশে ভূমির মালিকানা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয় বরং সামাজিক মূলধন (ংড়পরধষ পধঢ়রঃধষ) হিসেবে কাজ করে যা নারীর আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্বপূর্ণ কর্মকাÐে অংশগ্রহণের দ্বার প্রসারিত করে।
জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) একটি অন্যতম লক্ষ্যমাত্রা হলো জেন্ডার সমতা অর্জন এবং সকল নারী ও কন্যা শিশুর ক্ষমতায়ন। এছাড়াও, এসডিজি’র ১৯৯ টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৯ টি ভূমির সাথে সংশ্লিষ্ট এবং ২৪০ টি সূচকের মধ্যে ১২ টি ভূমি ভোগদখলের ক্ষেত্রে জেন্ডার-সমতা বিষয়ের সাথে সরাসরি প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।
মূলত বৈষম্যমূলক ক্ষমতা কাঠামো এবং পিতৃতান্ত্রিকতার কারণেই নারীরা ভূমির মালিকানা পাচ্ছে না। আমাদের উত্তরাধিকার সম্পত্তির বিষয়টি বিভিন্ন ধর্মীয় আইনে বিভিন্নভাবে বলা আছে। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে আমাদের সার্বজনীন কোনো আইন নেই। নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের যে প্রাপ্য, সেটাই পাচ্ছেন না। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে বেশিরভাগ নারীরা বাবার উপরে, ভাইদের উপরে, স্বামী এবং সন্তানদের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতার কারণে নারীরা উত্তরাধিকারের ব্যাপারে কোনো দাবি তোলেন না। ফলে, বেশির ভাগ নারীই তাদের উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন। যাঁরা কিছুটা সম্পত্তি পেয়েও থাকেন, সেটা আবার তাঁরা স্বাধীনভাবে ভোগ করতে কিংবা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না।
ড. আবুল বারকাত পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ৯৬ শতাংশ জমির মালিক পুরুষ, নারীদের মালিকানায় আছে মাত্র ৪ শতাংশ জমি। তবে এসব পরিসংখ্যান দরিদ্র নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ তাঁরা ভূমি ও সম্পদহীন। এ সকল ভূমিহীন নারী, বিশেষত নারী কৃষকের জমি-জলা-জঙ্গলসহ সরকারি বেসরকারি সকল সম্পদে অভিগম্যতা এবং নিয়ন্ত্রণ যেখানে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, সেখানে প্রান্তিক, ভূমিহীন নারীদের খাসজমিতে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বণ্টন নীতিমালাটিই বৈষম্যমূলক। এ নীতিমালায় বলা আছে, ভূমিহীন নারী যৌথ নামে স্বামীর সাথে খাসজমির জন্য আবেদন করতে পারবে। স্বামী পরিত্যক্তা বা বিধবা নারীর ক্ষেত্রে সক্ষম পুত্রসন্তানসহ আবেদন করার নিয়ম রয়েছে। অর্থাৎ এর মানে হলো নাবালক পুত্রসন্তান বা কন্যা সন্তানের মাতা হিসেবে কোন বিধবা বা একক নারী খাসজমি প্রাপ্তির অগ্রাধিকার তালিকায় স্থান পাবেন না। নারীর প্রান্তিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে খাসজমি বণ্টনের ক্ষেত্রে নারীদের অধিকার নিশ্চিত করার এই বিষয়টি নারী নীতিতেও সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। রাষ্ট্রীয় সম্পদ বণ্টনে এরকম বৈষম্যমূলক নীতি কার্যত অতি দরিদ্র নারীর খাসজমি পাওয়ার অধিকারকে ব্যাহত করবে। আর অতি দরিদ্রকে সম্পদ দেয়া না গেলে দারিদ্র বিমোচনের স্বপ্ন কখনোই বাস্তবে রূপলাভ করবে না। এ সকল নীতিকাঠামো ভূমিতে নারীর পূর্ণ অধিকার ভোগের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। আদিবাসীসহ অন্য সকল প্রান্তিক নারীরাও এক্ষেত্রে একইভাবে বঞ্চিত।
বাংলাদেশসহ বিশ^জুড়ে যেখানে নারীর সম-অধিকার এবং নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি অগ্রাধিকারের সঙ্গে বিবেচিত, সেখানে খাসজমি তথা পারিবারিক সম্পত্তিতে নারীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী। এ অর্ধেক জনসংখ্যাকে পশ্চাৎপদ রেখে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। সেজন্য, দেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত করার পাশাপাশি নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য ও অসমতা দূর করে উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় নারীদের শামিল করা প্রয়োজন।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু – ভূমি ও মানবাধিকার, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়নে বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা
ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, সা¤প্রদায়িক বিভাজন নীতির উপর ভর করে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম, সেই রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী এর জন্মলগ্ন থেকে পূর্ববঙ্গ (পূর্ব পাকিস্তান)-কে তাদের উপনিবেশ বিবেচনায় বিজাতীয় শাসন ও শোষণকে চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় সা¤প্রদায়িকতাবাদ চাপিয়ে দিয়েছিল। এহেন অভিপ্রায়ে পূর্ববঙ্গের জনগোষ্ঠীর তৎকালীন এক-তৃতীয়াংশ ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। ১৯৬৫ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার মাত্র ১৭ দিনের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের আওতায় জারীকৃত শত্রু সম্পত্তি আইনকে তারা এক্ষেত্রে ফলপ্রদ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায়ে এই শত্রু সম্পত্তিকেই অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ১৯৫১ সালের আদমশুমারি অনুসারে বাংলাদেশ ভূ-খন্ডে শতকরা ২৮ ভাগ মানুষ ছিলেন হিন্দু স¤প্রদায়ের। কিন্তু সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে তা নেমে আসে শতকরা ৮ ভাগে।
এছাড়া বর্তমান সময়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের একটি পরিচিত কৌশল হচ্ছে ফেসবুকে মিথ্যা স্ট্যাটাস দিয়ে ধর্মীয় অবমাননা করা হয়েছে এই অজুহাতে সংখ্যালঘুদের বাড়ি ঘরে হামলা করা, আগুন লাগানো ইত্যাদি। পাবনার সাঁথিয়া (২০১৩ সাল), কক্সবাজারের রামু (২০১২ সাল), ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার নাসিরনগর (২০১৬ সাল) সব ক্ষেত্রে একই ধরণের গল্প তৈরীর প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছে। করোনাকালীন লক-ডাউনের মধ্যেও ভোলার মনপুরায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে প্রায় ১০ টি হিন্দু বাড়ি-ঘর ভাংচুর করা হয় এবং কথিত হিন্দু যুবককে গ্রেফতার করা হয়। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যার নামে ফেসবুকে কথিত স্ট্যাটাস দেয়ার কথা বলা হয় পুলিশ তাকেই গ্রেফতার করে এবং এখন বেশিরভাগ ঘটনার তদন্ত শেষ হয় না এবং প্রকৃত অপরাধীরা কখনোই আইনের আওতায় আসে না। এ ধরনের ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার অভিযোগ, তারা নিরাপরাধী হয়েও লম্বা সময় জেল খেটেছে কিংবা নিখোঁজ হয়েছেন। নাসিরনগরের রসরাজ, রামু’র উত্তম বড়–য়া এবং রংপুরের টিটু রায়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সর্বশেষ সুনামগঞ্জের শাল্লার ঘটনা তার একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ। এই ফেসবুকে সাজানো ঘটনার পিছনে একটা অসৎ উদ্দেশ্য থাকে ধর্মীয় বিদ্বেষকে উস্কে দেয়া।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা ও আক্রমণের চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখতে পাবো সংখ্যালঘু নির্যাতনের বেশি ঘটনা ঘটে নির্বাচনকালীন, পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে। উদাহরণস্বরূপ ১৯৭০-এর নির্বাচনে তৎকালীন আওয়ামী লীগের জয়লাভ এবং অতঃপর ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে পাক-বাহিনীর নির্বিচারে সংখ্যালঘুদের হত্যাযজ্ঞ; ১৯৯০-এর অক্টোবরে আবার আক্রান্ত হয় সংখ্যালঘুরা, উদ্দেশ্য দেশের গণ-আন্দোলন স্থবির করা; ২০০১-এর নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার শিকার হয় এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, তখন সিরাজগঞ্জের ও ভোলার পূর্ণিমা-সীমাদের ধর্ষণ পরবর্তী আহাজারি কেউ শোনেননি বা শোনার প্রয়োজনও বোধ করেনি। অতঃপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পরবর্তী হামলার ঘটনাও সুবিদিত। ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে হিন্দু স¤প্রদায়ের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে দাবি করা হয়েছিল আমরা ভোটের অধিকার চাই না আমাদের নিরাপত্তা দিন। ২০০৮ সালের নির্বাচন পরবর্তী সে রকম সা¤প্রদায়িক হামলা না হলেও ২০১৪ সালে তা আবার ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সানের পি.ও ২৯/৭২ জারি করে শত্রু সম্পত্তি দেখভালের ভার ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ হতে বাংলাদেশ সরকারের উপর ন্যস্ত হয়েছে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চ ১৯৬৯ সালের এই অধ্যাদেশ বাতিল করলেও একই সাথে ঠবংঃবফ ধহফ ঘড়হ-ৎবংরফবহঃ ঢ়ৎড়ঢ়বৎঃু (অফসরহরংঃৎধঃরড়হ) অপঃ ১৯৭৪ (অপঃ ঢখঠও ড়ভ ১৯৭৪) নামক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ইতিপূর্বে সরকারের কাছে থাকা শত্রু সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি হিসাবে অভিহিত করে তার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সরকারের হাতেই রেখে দেন। বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ একাধিক রায়ে বলেন, ‘শত্রু সম্পত্তি আইন একটি মৃত আইন, এর ভিত্তিতে নতুন করে কোন সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণা করা বেআইনী।’ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতসহ দেশের প্রথিতযশা গবেষকদের গবেষণা থেকে আমরা জেনেছি ১৯৬৫ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মোট ২৭ লক্ষ হিন্দু খানা-র মধ্যে ১২ লক্ষ হিন্দু খানা মোট ২৬ লক্ষ একর ভূমি হারিয়েছে আর সেই সাথে হারিয়েছে স্থানান্তরযোগ্য অন্যান্য সম্পদ।
সরকার ২০০১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন সংসদে পাশ করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু আইনটি কার্যকর হয়নি। ২০০২ সালে তদানিন্তন জোট সরকার ক্ষমতাসীন হলে এক সংশোধনীর মাধ্যমে আইনটিকে স্থগিত করে চলমান সংখ্যালঘু নিপীড়নের ধারা অব্যাহত রাখে। সবশেষে ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের সর্বশেষ সংশোধনীটি পাস হয় যার মাধ্যমে অর্পিত সম্পত্তির ‘খ’ তফসিল বাতিল করা হয়। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। কারণ উক্ত সংশোধনীর মাধ্যমে অর্পিত সম্পত্তি বিষয়ক ৮০% ভুক্তভোগীকে ভোগান্তির হাত থেকে রেহাই দেবার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এতে মাঠ পর্যায়ে পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি ঘটেনি সেটাই সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের। এক শ্রেণীর দুর্নীতিপরায়ণ আমলাদের কারণে বার বার তার সদিচ্ছা ভূলুন্ঠিত হয়ে চলেছে। বর্তমানে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আপিল ট্রাইব্যুনাল থেকে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের রায় দেয়া হলেও জেলা প্রশাসক তা বাস্তবায়ন করছে না। যদিও আইনে এই রায় কার্যকরের জন্য তা ৪৫ দিনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়াও হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে কয়েকজন জেলা প্রশাসক এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছে। এর ফলশ্রæতিতে এই মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ঐ ভুক্তভোগী আর তার সম্পত্তি ফেরত পাবেন না। এছাড়াও বাতিল হওয়া ‘খ’ তফসিলভুক্ত সম্পত্তি নাম-জারি করতে গেলে ‘দখলে নাই’, উত্তরাধিকারীদের অনাপত্তি পত্র নেই প্রভৃতি বিভিন্ন অজুহাতে নাম জারি করছে না। ফলে ভ্ুক্তভোগীদের দূর্দশা কোন অবস্থায়ই কাটছে না।
ভ‚মি ও কৃষিতে আদিবাসীদের নিরাপত্তাহীনতা
সরকারি হিসেবে দেশে আদিবাসীদের সংখ্যা ৩০ লক্ষ বলা হলেও এ সংখ্যা বাস্তবে ৫০ লক্ষ এবং তার দুই-তৃতীয়াংশের বাস সমতলে। বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি নেই এবং তাঁদের ঐতিহ্যগত ভ‚মি অধিকারের বিষয়টিও স্বীকৃত নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০-এ আদিবাসীদের প্রথাগত ভ‚মি স্বত্ব ও ব্যবস্থাপনার বিষয়টির স্বীকৃতি থাকলেও পার্বত্য তিন জেলা বাদে দেশের অন্য অংশে প্রথাগত ভ‚মি স্বত্ব ও ব্যবস্থাপনার কোনো আইনগত স্বীকৃতি নেই। আদিবাসীদের অধিকার সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন নং ১০৭-এ বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করলেও বাংলাদেশের আইনী কাঠামোতে তার তেমন প্রতিফলন নেই।
বাংলাদেশে আদিবাসীদের ভ‚মি অধিকার ও কৃষিতে অভিগম্যতা পরিস্থিতি মোটেই সুখকর নয়। বরং বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ ঐতিহাসিকভাবে বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার। স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পূর্ণ হলেও দেশের আদিবাসী জনগণের এ বঞ্চনা নিরসনে সমন্বিত নীতি, কর্ম-পরিকল্পনা, কর্মসূচি বা উদ্যোগ কোনোটাই নেই। আদিবাসীদের অনুক‚লে উল্লেখযোগ্য যেসব রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তার বাস্তবায়নও অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয় নানা কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে কিংবা প্রশাসনের একাংশের সদিচ্ছার অভাবে থমকে আছে। ১৯৯৭ সালের সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তির মূল অংশ ভ‚মি বিরোধ নিস্পত্তিতে কার্যত কোনো অগ্রগতি নেই বরং ভ‚মি বিরোধের মাত্রা ক্রমশ বাড়ছে এবং পরিস্থিতি জটিলতর হচ্ছে। ভ‚মি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১-এর কাক্সিক্ষত সংশোধনী ২০১৬ সালে গৃহীত হলেও বিধিমালার অনুপস্থিতি, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, লোকবল ও বাজেটের অভাবে কমিশন কার্যকর কোনো ভ‚মিকা পালন করতে পারছে না। অনগ্রসর পার্বত্য অঞ্চলের জন্য একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করা হলেও পাহাড়ের আদিবাসীদের মানবাধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তায় তার তেমন ভ‚মিকা নেই। সমতলের আদিবাসীদের জমি-জায়গা যাতে বেদখল না হয়, তার জন্য ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৭ ধারায় বিশেষ বিধানাবলী রয়েছে। সমতলে আদিবাসীদের ভ‚মি অধিকার সংক্রান্ত এটিকেই একমাত্র আইনী রক্ষাকবচ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এ ধারায় বেদখল হয়ে যাওয়া জমি পুনরুদ্ধারে রাজস্ব কর্মকর্তা অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের কর্তব্যের বিধান আছে। তবে এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ৯৭ ধারার উদ্দেশ্য দেশব্যাপী মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে এবং বে-আইনীভাবে আদিবাসীদের বিপুল পরিমাণ ভূমি অ-আদিবাসী ব্যক্তিদের দখলে চলে গেলেও নির্বাহী বিভাগ এসব জমি পূনরুদ্ধারের কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি।
সাংবিধানিক স্বীকৃতি না থাকা, সংবেদনশীল নীতি ও আইনের অপর্যাপ্ততা, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে আদিবাসীদের প্রান্তিক অবস্থানের কারণেই মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম ও অন্যান্য অংশে আদিবাসীদের জায়গাজমি থেকে তাদের উচ্ছেদ ও বেদখলের ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে। এছাড়া আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষার জন্য সমন্বিত নীতি ও কর্ম-পরিকল্পনার অভাব, পার্বত্য চুক্তি ও আইনের অবাস্তবায়ন এবং সর্বোপরি সরকারের নিরাপত্তাবাহিনীসহ বিভিন্ন সরকারি এজেন্সির প্রতিনিধিদের অসংবেদনশীলতা ও পক্ষপাতমূলক আচরণও এসব ঘটনার অন্যতম নিয়ামক। স্থানীয় প্রভাবশালী ছাড়াও সরকার বনায়ন, ইকো-পার্ক, পর্যটন, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ বিভিন্ন প্রকল্পের নামে আদিবাসীদের ভূমি দখল করে নিচ্ছে। আদিবাসীরা ঐতিহ্যগতভাবে যেসব ভূমির মালিক, সেখানে তাদের মালিকানা অস্বীকার করা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত তাঁর ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি অফ আনপিপলিং অফ ইন্ডিজিনাস পিপলস: দ্য কেইস অফ বাংলাদেশ’ শিরোনামের গবেষণা গ্রন্থে (২০১৬) দেখিয়েছেন, ১৯৫১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ৬৪ বছরে সমতলের ১০টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ২ লাখ ২ হাজার ১৬৪ একর জমি কেড়ে নেয়া হয়েছে, যার দাম প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। একই গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘২৭ বছর আগে (১৯৮৯ সালে) পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী মানুষের অনুপাত ছিল ৭৫ শতাংশ, এখন (২০১৬ ) তা ৪৭ শতাংশ। পাহাড়িরা হারিয়েছে ভূমি-বনাঞ্চল আর আমদানি করা সেটেলার বাঙালিরা দুর্বৃত্ত আমলা প্রশাসনের যোগসাজশে তা দখল করেছে।’
আদিবাসীদের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি সবকিছুই ভ‚মিকেন্দ্রিক। ভ‚মি জবরদখল এবং উচ্ছেদের কারণে আদিবাসীরা কেবল তাদের বসতবাড়ি বা ফসলের জমি হারাচ্ছেন না, তাদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হচ্ছে, তাঁদের সংস্কৃতিও বিলুপ্ত হচ্ছে। আদিবাসীদের অস্তিত্ব ও নিজস্বতা রক্ষার জন্য তাদের ভ‚মি ও কৃষিতে নিরাপত্তার বিষয়টি তাই সর্বাগ্রে বিবেচনায় আনা জরুরি। যুগ যুগ ধরে তারা যে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন সেটি নিরসন এবং বৈষম্য লাঘবের জন্য একটি সংবেদনশীল আদিবাসী নীতি ও আইনী কাঠামোর পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং এই কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়নে আদিবাসীদের অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। তবে তার আগে প্রয়োজন নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রসমূহে আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়টির অন্তর্ভুক্তি।
সরকার ২০০৯ সালে আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও এখন তারা সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। এখন বলা হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কিংবা উপজাতি। আমাদের কথা হচ্ছে যেনামেই ডাকুন, তাদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার অঙ্গীকার তো সরকার বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব সময় করে এসেছেন। সেই কারণে সেই অঙ্গীকারের পূর্ণ বাস্তবায়ন তো সরকারেরই দায়িত্ব।
সুপারিশমালা:
ভ‚মি ও কৃষিতে সংখ্যালঘু, আদিবাসী এবং প্রান্তিক নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ও তাঁদের নিরাপত্তাহীনতা দূর করার জন্য নি¤েœাল্লিখিত সুপারিশসমূহ তুলে ধরতে চাই-
নারীর ভূমি অধিকার:
১. কৃষি খাসজমি বিতরণ নীতিমালায় বিধবা ও একক নারীর জন্য সক্ষম পুত্র সন্তানের শর্ত বাতিল করে কৃষি নির্ভর সকল ভূমিহীন সমতলের আদিবাসী নারীসহ দরিদ্র অসহায় নারীকে কৃষি খাসজমিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে;
২. নারী কৃষকের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। এবং বাজার ব্যবস্থায় নারীর অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে;
৩. নারী কৃষকের যৌথ চাষাবাদের উদ্যোগ এবং সমবায় ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন, মৎস্য চাষে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সকল প্রকার সহায়তা প্রদান করতে হবে;
৪. নারী কৃষকের ভূমিহীনতা বিবেচনায় নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় (জামানতবিহীন অথবা সহজ শর্তে) কৃষি ব্যাংকসহ সকল রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ / অর্থায়নের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে;
৫. বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন পরিবর্তন করে সার্বজনীন পারিবারিক আইন প্রণয়ন করে সকল ধর্মের নারীর সম্পদে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে;
৬. সিডও পর্যবেক্ষণ কমিটির সুপারিশমালা আমলে নিয়ে পূর্ণ অনুমোদন এবং বাস্তবায়নের দ্রæত উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন: আইন কমিশনের মতামত অনুসারে উদ্যোগ গ্রহণ, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ইসলামিক চিন্তাবিদদের সাথে আলোচনা ইত্যাদি।
৭. আদিবাসী, সংখ্যালঘু নারীসহ সকল নারী ও শিশু নির্যাতন, হত্যা, গুম, ধর্ষণ ইত্যাদি কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। নারী-শিশু নির্যাতন অভিযোগের তদন্ত দ্রæতকরণ এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভূমি অধিকার:
ক. সকল ধরনের সাম্প্রদায়িক ঘটনা তদন্ত ও দ্রæত বিচার নিশ্চিত করতে জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করতে হবে এবং কমিশনকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা প্রদান করে এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করতে হবে;
খ. অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত রিট পিটিশন নং ৮৯৩২/২০১১-তে দেয়া উচ্চ আদালতের ৯ দফা নির্দেশনাসমূহ দ্রæত বাস্তবায়ন করতে হবে;
গ. যে সকল ক্ষেত্রে অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত ভুক্তভোগীদের পক্ষে রায় ও ডিক্রি প্রদান করা হয়েছে তা বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা দ্রæত কার্যকর করতে হবে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র মোতাবেক আপিল ট্রাইব্যুনালের রায় ও ডিক্রির বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর জনস্বার্থবিরোধী রিট না করার বিষয়ে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ ও ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে দ্রুত পরিপত্র জারি করতে হবে;
ঘ. অর্পিত সম্পত্তির আওতায় ২০১৩ সালে বাতিল হওয়া ‘খ’ তফসিলভুক্ত সম্পত্তির খাজনা নেবার ক্ষেত্রে তহসিল অফিসের অস্বীকৃতি এবং এসি (ল্যান্ড) অফিসের গড়িমসি ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।
আদিবাসীদের ভূমি অধিকার:
১. সরকারের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী আদিবাসীদের ভ‚মি অধিকারের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য তাদের আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে;
২. কৃষিজমি, বন, পাহাড় রক্ষা এবং ভ‚মিতে আদিবাসীদের প্রথাগত অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে;
৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে, বিশেষ করে পার্বত্য এলাকার ভ‚মি বিরোধের দ্রæত ও কার্যকর নিস্পত্তি করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ‚মি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশনকে যথাযথভাবে কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় জনবল এবং বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।
৪. জবরদখল ও উচ্ছেদ থেকে প্রান্তিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে রক্ষা এবং বন ও প্রাকৃতিক সম্পদে তাদের অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। সমতলের আদিবাসীদের ভ‚মি অধিকার সুরক্ষায় আদিবাসী ভ‚মি কমিশন গঠন করতে হবে।
৫. রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০-এর ৯৭ ধারার যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। বেদখল হয়ে যাওয়া জমি পুণরুদ্ধার ও প্রকৃত আদিবাসী মালিক বা তাঁর উত্তরাধিকারীকে ফেরত প্রদানের যে কর্তব্য ও বাধ্যবাধকতার বিধান রয়েছে তা কার্যকর করতে হবে।